এই লোকটা কখনো অনুতপ্ত হয় না। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, কিই বা এমন করলো যে সে অনুতপ্ত হবে? হুম। আসলে আমি এই চায়ের দোকানে ঠিক আমার মুখোমুখি বসে যে লোকটা একটা লম্বা তক্তা বিস্কুট রং চায়ে ডুবিয়ে ডুবিয়ে আয়েশ করে খাচ্ছে তার কথা বলছি। এমনিতে দেখতে খুবই সাধারন এবং নিরীহ গোছের, লম্বা ঢ্যাঙ্গা মতোন দেখতে, মাথার কোঁকড়া চুলগুলো সামনের দিকে হালকা হয়ে এসেছে আর জানান দিচ্ছে আশু টাকের পূর্বলক্ষণ। গায়ের রঙ ফর্সাই কিন্তু ওর লম্বা মুখটা এতোটাই আঁধার করে রেখেছে যে ওকে ঠিক ফর্সা দেখতে লাগছে না। দেখে মনে হচ্ছে কি যেন একটা ঘটনা ঘটেছে যা নিয়ে লোকটা ভীষণ বিরক্ত এবং আবার সে চাচ্ছে ব্যাপারটা যেন কেউ বুঝতে না পেরে যায়। এই এতোক্ষণে চাওয়ালা, কিংবা দোকানের আট ন বছরের ছেলেটা, যে খদ্দেরদের চায়ের গ্লাসগুলো এগিয়ে দিচ্ছে আর শেষ হলে ফেরত নিয়ে গরম পানির গামলায় ডুবিয়ে রাখছে, কিংবা চা খেতে আসা আর সব লোকজন, এমন কি যে নায়িকার মতো মেয়েটা এদিকটায় এসে একটা ঠিকানার দিকনির্দেশনা খোঁজ করে গেল, কারো দিকেই লোকটা সরাসরি তাকায় নি এমন কি একবার মুখটা পর্যন্ত তোলেনি। আমি খুব সাবধানেই লোকটার ওপর নজর রাখছি আজ নিয়ে চারদিন হলো। লোকটা ঠিক ধরতে পারছে না, কিন্তু মনে হচ্ছে আন্দাজ করছে যে কেউ একজন তার ওপর নজর রাখছে আর তাই প্রতিদিনই আরো বেশি সাবধান হয়ে যাচ্ছে। লোকটা ধাপ্পা দিতে একেবারে একটা চালু মাল। প্রথম দুদিন ঠিক নজর থেকে ফসকে গিয়েছিল। তবে গতকাল বিকেলে ঠিক আমি ওর বাড়ি পৌঁছুতে পেরেছি, অনেক বেগ পেতে হয়েছে কারন লোকটা হাঁটা এবং অঙ্গভঙ্গি পাল্টে নিতে খুবই ওস্তাদ। আর ওর অমন পোষাকে খুব সহজেই ভীড়ে মিশে যেতে পারে। তবে একটাই সুবিধে হয়েছে কারন এই চারদিন ধরে লোকটা গাঢ় নীল রঙের জিন্স এবং একটা মলিন গাঢ় কাঠ বাদাম রঙা ফুলহাতা শার্টই পরে বেরিয়েছে। লোকটা খুবই চতুর ভাবে হাঁটে এবং দাঁড়ায় কিংবা বসেও। তবে আমি ঠিক ধরতে পেরেছি যে ওর পা দুটো একটু বেশিই লম্বা। দুদিনের পর্যবেক্ষণ কাজে লাগিয়ে পরে লোকটাকে তৃতীয় দিন অর্থাৎ গতকাল ঠিক চোখে চোখে রাখতে পেরেছি। আর সারাদিন কাজ সেরে এসে এই দোকানটাতেই চা খেয়ে যখন কয়েকটা গলি পেরিয়ে ডান দিকের একটা ছোট দরজার ভেতর দিয়ে মাথা নুইয়ে ঢুকে পড়লো আমি নিশ্চিত হলাম যে এটাই ওর বাড়ি। কিন্তু লোকটা ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে দিল। আর আমি আবার অন্ধকারে পৌঁছে গেলাম কারন যতটুকু দেখতে পেয়েছি, তা শুধু ওই দরজাটার ভেতর শুধু এক ঘুটঘুটে অন্ধকারই। বাড়িটা পাঁচ তলা আর বুঝতেই পারলাম না লোকটা আসলে ঠিক কয় তলায় থাকে। তারপরও বুকে আশা নিয়ে ওই বাড়িটায় ঢুকে পড়া সবচেয়ে উঁচু ডিসলাইনের তারটাতে আমি ঠায় বসে রইলাম। ও হ্যাঁ, আপনাদের বলাই হয়নি আমি আসলে একটা খুবই সাধারন ধুসর কালো রঙের পাতি কাক।
যাই হোক, বসে থেকে লাভ হয়েছিল কারন লোকটা নিজেই পাঁচতলার দক্ষিণের জানালাটা বন্ধ করতে এলো আর বন্ধ করেই সাত তাড়াতাড়ি মরিচা আর সবুজ রঙের পর্দাগুলোও বেশ ভাল করে টেনে দিল। এই সময়টুকুর মধ্যেই খেয়াল করলাম যে ঘরে একটা মেয়ে আছে, আর লোকটা মেয়েটাকে সেই একইরকম মুখ কালো করেই কিছু বলছে কিংবা বকেই চলেছে যেন। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম কিন্তু জানলাটা আর খুললো না সন্ধ্যে হবার আগ পর্যন্ত। তাছাড়া মনে হলো ঘরটাতে ওই একটা মাত্রই জানলা। কি আর করবো, সন্ধ্যেও হয়ে এসেছিল তাই গতকাল এই পর্যন্ত দেখেই বাসায় ফিরে গিয়েছিলাম।
আজ সকাল সকাল ভালো করে আলো ফুটতেই আমি আবার লোকটার বাড়ির সামনে গেলাম আর সেই ডিসলাইনের তারটার ওপর গিয়ে বসলাম, তবে একটু জানালাটার কাছাকাছি গতকালের চেয়ে। চারদিকটা একটু ভালো করে দেখলামও আস্তে ধীরে। এদিক ওদিকও গেলাম কাছেধারে, কিন্তু জানালাটা নজরে নজরে রাখতে লাগলাম ঠিক। বাড়িটার দুধারে টানা ছোট ছোট দোকানপাট আর রাস্তায় মাঝে মাঝেই বসে পড়েছে সবজি আর মাছওয়ালারা। এই গলিটা পার হলেই একটা বড় কাঁচা বাজার শুরু হয়ে গেছে। গলিতে একটা খাবার হোটেলও আছে, ওখানে সকাল সকালই পরোটা, সবজি, চিকেন স্টু আর ডিমভাজার ধোঁয়া ওঠা ক্রেতাবিক্রেতাদের হট্টোগোল, ইয়া বড় কেতলিতে চা ফুটছে তো ফুটছেই বিরামহীণ। মানুষ সব চেঁচিয়ে কথা বলছে শুধুশুধুই। এই বেচাবিক্রির হাটে আমি কিছু মাছের পেটের অংশ পেয়ে গেলাম সরু নালাটার ধারে, ভালোই হলো, মুখে করে নিয়ে আবার তারটায় গিয়ে বসলাম আর সকালের খাবারটা সেরে নিলাম তা দিয়ে। আরও অনেক কাকেরাও ভীড় করেছে ওই বেড়ে আসা হাটটা ধরে। ওরা জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই আমি চোখ দিয়েই বুঝিয়ে দিলাম যে আমি একটা কাজে এসেছি। আপাতত ওরা খাবার শিকারে ব্যস্ত, তাই এখন আর তেমন একটা কিছু জানতে চায়নি। মাছের পেটটা খেতে খেতেই দেখলাম ঢ্যাঙা লোকটা স্যান্ডোগেঞ্জি আর চেক পাজামা পরে বাড়ির দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো। বেরিয়েই একবার চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে সোজা খাবার হোটেলটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো আর হাতের ইশারাতেই অর্ডার করলো। তারপর কাগজে মোড়া পরোটা আর সাথে রাখা প্লাস্টিকের পানির বোতলের অর্ধেকটা ভর্তি চা হাতে আবারও লম্বা লম্বা পা ফেলে ওর বাড়িটার ছোট দরজাটা দিয়ে ভেতরের অন্ধকারে ঢুকে পড়লো। আমি কাছেই একটা ঢিলে হয়ে যাওয়া কল থেকে চুইয়ে পড়া পানি কয়েক ঢোক খেয়ে আবারও জানালাটাতেই চোখ রাখলাম। সূর্যটা যখন বেশ প্রথম প্রহরের তেজ পেল দেখলাম লোকটা একটা ছোট দরজাটা দিয়ে বেরুলো, পরনে সেই গাঢ় নীল রঙের জিন্স প্যান্ট আর কাঠবাদাম রঙের শার্টটা। বেরিয়ে চারদিকটা ভালো করে একবার দেখে নিয়ে মাথাটা নিচু করে পিঠটা একটু গুঁজে নিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে লোকটা হাঁটতে শুরু করলো। আমিও পিছু পিছু নজর রাখতে লাগলাম। লোকটা এই আঁকাবাঁকা গলিগুলো পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠেও হাঁটতেই থাকলো আর হাঁটতেই থাকলো। মিনিট বিশেক হাঁটতে হাঁটতে শেষে বড় রাস্তাটা যেখানে পৌঁছেছে একটা প্রচন্ড ব্যস্ত মোড়ে তার একটু আগে হাতের বাঁ দিকের একটা কাঠের ফার্নিচারের দোকানে লোকটা ঢুকে পড়লো। বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে দোকানটা বেশ বড়ই। প্রায় এক ঘন্টাতেও যখন বেরুলো না, ধরে নিলাম এখানেই কাজ করে লোকটা। চারপাশটা ভালো করে বারকয়েক চিনে নিয়ে আমি আবার লোকটার বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।
লোকটার বাড়ি পৌঁছেও দক্ষিণের জানালাটা বন্ধই পেলাম। তাই উল্টো দিকের একটা বাড়ির কার্নিশে গিয়ে বসে একটু ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে জানলাটার দিকে নজর রাখতে লাগলাম। এলাকার দুটো উৎসুক পাতি এবারে আমার কাছে এলো আর জানতে চাইলো ব্যাপারটা। ওদের একজন চ্যাংড়া মতোন ছটফটে, জেল্লা বেরুচ্ছে চকচকে পালক দিয়ে, চোখদুটো কৌতুহলী আর স্বচ্ছ। অন্যজন মাঝবয়সী, একটু ময়লা শরীর কিন্তু হাবভাবে চাওনিতে বেশ বিচক্ষন। ভালো করে ওদের চোখগুলো পড়ে নিয়ে একটু বিশ্বাস জন্মালো। তাই আর না লুকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "ওই ঢ্যাঙা লোকটাকে চেনো? ওই দক্ষিণী জানলার ঘরে থাকে। চোখগুলো গর্তে ঢোকা, লম্বা লম্বা পা, ভীতু ঘাড়ের লোকটা, চেনো?"
চ্যাংড়া পাতিটা বললো, "আরে চিনি তো। এই তল্লাটের সবকটা মানুষ দিব্যি চিনি। ও হলো কিপ্টে ঝিঙে। ভীষণ কিপ্টে। পরোটা আর চা ছাড়া কিছু খায় না, লম্বা লম্বা পা দুটো আছে, শুধু হেঁটেই বেড়ায়।"
আমি শুধালাম, "ব্যাস! এইটুকুই জানো? আর কিছু না?"
চ্যাংড়া পাতি উত্তর দিল, "জানবোনা কেনো ভাই? দিব্যি জানি। এই তল্লাটের সবার হাঁড়ির খবর জানি আমরা। ওই কিপ্টে ঝিঙে একলা থাকে। না যায় কারো ঘরে, না কাউকে ডাকে।আর না পারতে কথাও কয় না, তাকায়ও না কারো দিকে। যতোটা পারে ইশারায় কাজ সারে। সকাল হলে কাজে যায়। সন্ধে হলে বাড়ি ফেরে। ছুটির দিনে ঘরেই থাকে বন্দী। ওই তো ওর একটি মাত্র জানলা, রাতদিন তা বন্ধই থাকে বলতে পারো।" এই পর্যন্ত বলে চ্যাংড়া পাতি একটু দম নিল। তারপর যেন হঠাৎ মনে পড়তেই বললো "আর হ্যাঁ! হপ্তাখানেক হলো বিয়ে করে এনেছে এক ফুটফুটে মেয়ে। এই এক্কেবারে রোগা, নরম নরম গালের ছোট্ট সে মেয়ে। ঝকঝকে মেহগনির গোটার মতোন তার গায়ের রঙ, কালো টানাটানা চোখদুটো আর মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল। আমরা তো ওকে দেখেই অবাক! কিপ্টে ঝিঙের অমন চোখ ধাঁধানো বউ! কখন এলো জানতেই পারিনি কেউ। সূর্য যখন মাথার ওপর ওঠে তখন সে খোলে ওই দক্ষিণের জানলাটা। নইলে তো দেখতেই পেতাম না ওকে। খুব ভালো ও জানোতো, পরোটাটা, রুটিটা, রান্না মাংসের টুকরোটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেয় আমাদের।"
চ্যাংড়া পাতির বর্ণনা শুনে আমি বেশ অবাকই হলাম। এতো অবলিলায় সরল বিশ্বাসে নিজের এলাকার কারো এতো খবর আমার মতো অচেনাকে দিয়ে দেবে, এতোটাও আশা করিনি। কৃতজ্ঞতার সাথেই বললাম "ধন্যবাদ ভাই। তুমি এই বয়সেই বড় উদার। এই কথাগুলো জানার বড্ড ছিল দরকার। কিন্তু তুমি ঠিক জানো যে জানো সবটাই ওই লোকটার?"
মাঝবয়সীটা বিচক্ষণ এবার একটু গা ঝাড়া দিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে গম্ভীর গলায় জানতে চাইলো "ঠিক করে বলো তো, কি আছে এমন যা টেনে এনেছে তোমায় এইখানে? জানো কি কিছু তুমি যা জানি না আমরা মোটেও?"
আমি ওর চোখে চোখ রেখেই বললাম, "ওই লোকটা লুকোচ্ছে কিছু সবার কাছ থেকে। গলির মুখের চায়ের দোকানে আমি পড়েছি ওর শরীরের ভাষা ঠিকঠাক। ও লুকোচ্ছে ভয়ানক কিছু। তাইতো ছুটে ছুটে ধেয়ে এলাম ওর বাড়ি।তোমরা ঠাওর করোনি একবারও?"
মাঝবয়সী বিচক্ষণ কিছুক্ষণ যেন কিছু গভীরভাবে ভাবলো। তারপর ধীরে ধীরে বলতে লাগলো, "ছ'মাসের কিছু বেশি হবে লোকটা এসে উঠেছে এই তল্লাটে। বহুদিন ধরে দেখছি এই মানুষদের। সন্দেহ যে হয়নি এমনটাও নয়। লোকটা স্থির একদন্ড দাঁড়ায় না কোথাও। চালচলন স্বাভাবিক বলা চলেনা ঠিক। আর হঠাৎ দেখছি একটা বউ, সে আবার..."
আমি কথার মাঝেই বলে উঠলাম, "তোমরা ঠিক জানো যে ওই মেয়েটা ঢ্যাঙা লোকটার বউ?"
মাঝবয়সী বিচক্ষণ আবার যেন কিছুক্ষণ ভাবলো কিছু, তারপর বললো, "সে তো আমরা ভেবে দেখিনি আগে তেমন করে। তবে এখন যে আমারও বড় খটকা লাগছে। চলো তবে খোঁজ করা যাক। সূর্য মাথার ওপর উঠলো বলে... বউটা একটু পরেই জানলাটা খুলবে।"
আমরা তিনজনই উড়ে গিয়ে উঁচু ডিসলাইনের তারটার ওপর বসলাম। কিছুক্ষণ পর ঠিকই একটা মেয়ে দক্ষিণী জানলাটা খুললো। সেদিন ঠিকঠাক বুঝতে পারিনি তবে চ্যাংড়াটা সত্যিই বলেছে ভীষণ রোগা হলে কি হবে মেয়েটার এলোমেলো কোঁকড়ানো চুলের মাঝে নরম নরম ফোলা ফোলা গাল আর মেহগনির গোটার রঙের মসৃণ ত্বক। গায়ে একটা ভীষণ ঢোলা কোঁচকানো সাদাকালো চেক শার্ট, হাতা দুটো নেমেছে কনুইয়ের নিচে, ওর নিজের পোষাক বলে ঠিক মনে হচ্ছেনা। আমি আরেকটু কাছে গিয়ে ঠাওর করে দেখতেই মনে হলো কালো টানা টানা চোখ দুটোর কোণ থেকে দুগাল জুড়ে কান্নার দাগ হয়ে আছে। মেয়েটার হাতে একটা আস্ত পরোটা ঝুলে আছে। জানলার গ্রিলে নাকমুখ চেপে দূরে কোথাও একটা উদভ্রান্তের মতো তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ তারপর পরোটাটা ছোট ছোট টুকরোয় ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিচের রাস্তায় ছুঁড়ে দিতে থাকলো। মনে হলো যেন ওর ঠোঁটদুটো নড়ছে। আমি সাহস করে জানলাটার কোণায় গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ বোঝার চেষ্টা করলাম কি বলছে ও, কিন্তু নাহ কিছুই বোঝা গেল না। তবে মেয়েটা যেন খেয়ালই করলো না আমাকে বা করলেও ভয় পেলো না একটুও। এভাবে অনেক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শেষে কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে বোকার মতো জিজ্ঞেস করে বসলাম, "কে গো মেয়ে তুমি? বাড়ি কোথায়? কি করে এলে এখানে? কাঁদছোই বা কেন বলোতো?" মেয়েটা আমার কথা বুঝলো কি না কে জানে, ওই দূরে দৃষ্টি রেখেই বসা ফ্যাসফ্যাসে অথচ স্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো, "বাড়ির রাস্তা তো আমি ভুলেই গেছি।" আমি এক মূহুর্তে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম আর উড়ে এসে তারের ওপর বসলাম চ্যাংড়া আর বিচক্ষণের মাঝে। হড়বড় করে ওদের বললাম "ভাই, এ মেয়ে জানোতো আমাদের ভাষা বোঝে! কি অদ্ভুত ব্যাপার!" বিচক্ষণ সরু চোখে তাকিয়ে বললো "তোমার মাথা ঠিক আছে তো? উল্টোপাল্টা কথা বলছো বড়? মানুষ কখনো পাতিদের ভাষা বুঝতে পারে?" আমি ভয় পাওয়া গলাতেই বলতে থাকলাম "তা পারে না। কিন্তু সত্যি বলছি ভাই এ মেয়েটা পারে। তুমি পরখ করেই দ্যাখো।" বদমাস চ্যাংড়াটা আমার কথা শুনে হাহা হেসে হেসে আকাশে ছোট দুপাক ঘুরে নিল আর বিচক্ষণ আবারো কি যেন গভীর চিন্তা করে বললো "বেশ তো, চলো তবে পরখ করেই দেখা যাক। যাই একসাথে ওর কাছে। তুমিই কথা বোলো ওর সাথে। দেখি ও বোঝে কি না।" আমি আর বিচক্ষণ জানলাটার দুই কোণে বসলাম গিয়ে আর চ্যাংড়াটা একটু ওপরে শূন্যে ভেসে রইলো। আমার ভীষণ ভয় করতে লাগলো, এখন যদি মেয়েটা কথা না বোঝে তবে আমাকে পাগল ভেবে এরা হয়তো তাড়িয়েই দেবে। মেয়েটা ঠিক একইভাবে গ্রিলে নাকমুখ চেপে দূরে তাকিয়ে আছে। আমতা আমতা করে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম "বললে না মেয়ে কি করে এখানে এলে? আর বাড়ির কথা কি যেন বলছিলে?" মেয়েটা একই ভঙ্গিতেই জবাব দিল "বাড়িতে বাবা আছে, বোন আছে, ভাই আছে, মা আছে। মাটাতো খুব মারে, খেতে দিতে চায় না, নতুন জামাও না। তাইতো পালিয়েছিলাম। আর হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির রাস্তা ভুলে গেলাম।" এতটুকু বলেই একটু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আমি আবারো ভয় পেয়ে গেলেও একটু স্বস্তি যেন পেলাম ওর জবাব শুনে। বিচক্ষণের চোখদুটো বিষ্ময়ে এত্তো বড় বড় হয়ে গেল। চ্যাংড়াটা বিষ্ময়ে আর উৎসাহে একেবারে মেয়েটার চোখ বরাবর নেমে এলো। আর হড়বড় করে জিজ্ঞেস করলো "তা তো বুঝলাম। এখানে এলে কি করে? কিপ্টে ঝিঙে... মানে এ বাড়ির লোকটা... ও কি তোমার বর?" চ্যাংড়ার কথা শুনে মেয়েটা কান্না থামিয়ে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো। তারপর হাসতে হাসতে পেটে হাত দিয়ে বলতে লাগলো "কি বল্লে??? কিপ্টে ঝিঙে!!!" বলেই আবারো বেদম হাসতে লাগলো। ওর হাসি দেখে আমরাও এতো বিষ্ময়ের মাঝেও হাসতে লাগলাম। মেয়েটা কোনরকমে হাসি থামিয়ে বললো "ওই কাকুটা আমার বর হতে যাবে কোন দুঃখে? সে তো অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। আমি পথ হারিয়ে ফুটপাতে বসে খুব কাঁদছিলাম। কাকুটা এসে আমার মাথায় হাত রাখলো আর আমার সব দুঃখের কথা শুনলো। তারপর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে আদর করে বললো 'থাক। আর কেঁদো না। তুমি বরং চলো আমার সাথে। এভাবে রাতবিরেতে পথে ঘাটে অনেক বিপদ আপদ। তার চেয়ে চলো আমার বাড়ি। সকাল হলে দুজন মিলে তোমার বাড়ি খুঁজতে বেরুবো। কেমন?" বিচক্ষণ এতোক্ষণে কথা বলে উঠলো "সে তো ভালো কথাই বলেছে লোকটা। তারপর?" মেয়েটা গাল ফুলিয়ে আবারো গ্রিলে নাকমুখ চেপে উদাস হয়ে গেল। আর অভিমানি গলায় বলতে থাকলো "আমাকে নিয়ে এলো এখানে। খেতে দিল। তারপর আদর করে ঘুম পাড়ালো। কিন্তু সকালে উঠে দেখি ঘরে কেউ নেই। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। টেবিলে খাবার আর পানি রাখা। প্রতিদিন এমনই চলছে। রাতে আদর করে খাইয়ে দেয়, ঘুম পাড়িয়ে দেয় আর সকাল সকাল তালাবন্ধ করে চলে যায়। ওই টেবিলে খাবার আর পানি ঢাকা দেয়া থাকে।" আমরা কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। আর এর মধ্যে মেয়েটা আবারো কাঁদতে শুরু করলো।
বিচক্ষণ আমাদের ইশারা করলে আমরা ওকে অনুসরন করে তিনজনই উল্টোদিকের বাড়িটার কার্নিশে গিয়ে বসলাম। বিচক্ষণ খুব গম্ভীর গলায় বললো "ব্যাপারটা মোটেও মামুলি তো নয়ই, বরং বেজায় ভয়ঙ্কর। এই মানুষেরা হলো সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাণী। কম দিন তো ওদের দেখছি না। বেচারি মেয়েটা ভীষণ বিপদে পড়েছে। আর ওই কিপ্টে ঝিঙে বিরাট এক শয়তান আর বেজায় ধুরন্ধর ও সাবধানি। মেয়েটাকে সাহায্য করতে হলে খুব সাবধানে করতে হবে।" আমি বললাম "হুম। ওই ব্যাটা মহা ধুরন্ধর। খুব সাবধানে এগোতে হবে। আমি বলি কি আজও বরং ওর ওপর নজর রাখি আমি। তোমরা এইদিকে মেয়েটাকে ওই ঘরটা থেকে বের করার কোন রাস্তা আছে কি না তা একটু খুঁজে দেখো। তোমরা তো এই এলাকারই পাতি।"
বিচক্ষণ বললো "তা বেশ। আমরা এই বাড়ির চারপাশটা ভালো করে চষে নিই আগে। কাল সকাল সকাল এখানেই আবার দেখা করবো।"
আমি বিচক্ষণ আর চ্যাংড়াকে বিদায় জানিয়ে সেই বড় রাস্তার ফার্নিচারের দোকানের পাশে যে ডাস্টবিনটা আছে তার ওপর গিয়ে বসলাম। ভালোই হলো কারন এখানে কিছু খাবার দাবারও পেয়ে গেলাম। দুপুরটা একটু পড়ে আসলে কিপ্টে ঝিঙে বেরুলো দোকান থেকে আর একটু ডানে হেঁটে গিয়ে একটা গলিতে ঢুকে পড়লো। একটু যেতেই গলির ওপরেই একদিকে বেঞ্চি পাতা একটা খাবার বোঝাই ভ্যান। লোকটা বেশ আয়েশ করে বেঞ্চিতে বসলো আর খাবার অর্ডার করলো। মুহূর্তেই চটপটে ভাতওলাটা আগে থেকে বেড়ে রাখা এক থাল ভাতের ওপর এক চামচ পাঁচমিশেলি সবজি আর দু'চামচ ডাল ঢেলে কিপ্টে ঝিঙের দিকে এগিয়ে দিল। কিপ্টে ঝিঙে সব ভাত একসাথে মেখে নিয়ে ইয়া বড় বড় গ্রাসে খুব তাড়াতাড়ি খেতে লাগলো, যেন বা ওর কিসের তাড়া আছে। খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে দামও চুকিয়ে দিল ঝটপট। তারপর পাশের বিড়ির দোকানটায় গিয়ে দুটো বিড়ি কিনলো আর একটায় আগুন ধরিয়ে ধীরে সুস্থে আয়েশ করে টানতে লাগলো। এই সময়টায় সে চারদিকটা বেশ স্বাভাবিক ভাবে মাথা সোজা রেখেই দেখতে লাগলো। বিড়িটা ফুরিয়ে যেতেই মাটিতে ফেলে স্যান্ডেল দিয়ে চেপে আগুনটা নেভালো আর তারপর আবার লম্বা পা চালিয়ে ফার্নিচারের দোকানে ফিরে গেল। তারপর একেবারে বেরুলো বিকেল পাঁচটা নাগাদ। বেরিয়েই দ্রুত হেঁটে গেল বড় রাস্তা ফেলে গলির মুখে তারপর যথারীতি চায়ের দোকানটায় গিয়ে বসলো। দ্রুত চা খাওয়াও শেষ করলো। আমি নজর রাখতে রাখতে আজো ওর বাড়ি পর্যন্ত গেলাম। ওখানে পৌঁছে অবশ্য চ্যাংড়া কিংবা বিচক্ষণ কাউকেই দেখতে পেলাম না। খেয়াল করলাম দক্ষিণী জানলাটা বন্ধ। কি আর করবো, আলো থাকতে থাকতে তাড়াতাড়ি বাসার দিকে রওনা দিলাম।
সকাল হতেই যা পেলাম খেয়ে নিয়ে পৌঁছে গেলাম কিপ্টে ঝিঙের বাড়ির উল্টো দিকের কার্নিশে। বিচক্ষণ আর চ্যাংড়াও চলে এলো একটু পরেই। আমরা তিনজন মিলেই নজর রাখলাম দরজাটার দিকে। আগের দিনের মতোই প্রথম বেলার রোদটা তেতে উঠতেই কিপ্টে ঝিঙে দরজা দিয়ে বেরুলো। আজ বেশ নতুন নীলের ওপর ছাই রঙা নকশার একটা শার্ট পরেছে। আর মনে হলো মন মেজাজও বেশ ফুরফুরে। যদিও সে একই ভাবে মাথা নিচু করে লম্বা লম্বা পা ফেলেই চলতে শুরু করলো, ওর মনের খুশিটা যেন তারপরও আমাদের চোখ এড়ালো না। পরিকল্পনা মতো আজ চ্যাংড়া ওর পিছু নিল, আমি আর বিচক্ষণ জানলাটার ওপর চোখ রেখে কার্নিশে বসে রইলাম। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার কিপ্টে ঝিঙে চলে যাবার আধ ঘন্টার মধ্যে ফুটফুটে মেয়েটা জানলা খুলে তারস্বরে চেঁচাতে লাগলো। উল্টোদিকের বাড়ির কার্নিশ থেকে আমরা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না যে কি বলে চ্যাঁচাচ্ছে, কিন্তু হঠাৎই শুনতে পেলাম ওপরের জানলা থেকে এক মাঝবয়সী মহিলা প্রচন্ড বিরক্তিভরা গলায় বলে উঠলো "ধ্যাৎ! আজ সকাল সকাল শুরু হলো ওই গোঙ্গা মেয়েটার গোঙ্গানি। এবারে কি পাগলও হয়ে গেল মেয়েটা? জানলায় কান পাতা দায় হলো সকাল সকাল!" মহিলার কথাটার মাথামুন্ডু বোঝার চেষ্টা না করেই আমরা দুজন মিলে জানলার ধারে মেয়েটার কাছে গেলাম। বেচারি খুব কাঁদছে, দেখে মনে হচ্ছে ওর কোথাও খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। আমরা কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটা আরো জোরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো "গত রাতে ভেবেছিলাম পালিয়ে যাবো। কিন্তু শয়তান লোকটা দরজায় ভাঙা কাঁচের টুকরো বিছিয়ে রেখেছিল। অন্ধকারে পায়ের তলায় বিঁধে গেছে অনেকগুলো কাঁচের টুকরো। খুব যন্ত্রণা। খুব কষ্ট। শয়তানটা টেনে টেনে সব বের করেছে। খুব রক্ত পড়ছে। খুব ব্যাথা। আমাকে বাঁচাও তোমরা।" মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়লো। আতঙ্কে আমাদের কারুরই মাথা কাজ করছে না। বিচক্ষণ একটু নিজেকে সামলে নিয়ে বললো "তুমি কেঁদোনা গো ফুটফুটে মেয়ে। একটু কষ্ট করে ধৈর্য্য ধরো। একটা ব্যাবস্থা ঠিক করবো।" আমরা ওর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে কার্নিশে ফিরে এলাম। দুজনের মুখেই কোন কথা সরছে না কোন। এমন সময় চ্যাংড়া হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এলো আর না জিরিয়েই বলতে লাগলো "কিপ্টে ঝিঙে বড় রাস্তায় একটা বাসে উঠে পড়েছে আর বাসটা গেছে পশ্চিম দিকে। আমি কিছুদূর তাড়া করার চেষ্টা করেও পারলাম না আর। তাই ফিরে এলাম এখানে। চ্যাংড়ার কথা শুনে ভয়ের অনুভূতিটা আরও বেড়ে গেল। মন বলতে লাগলো যেন এর চেয়েও আরও খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে। বিচক্ষণ জানালো আমাদের সবার আগে ঠিকঠাক ওষুধের ব্যবস্থা করা উচিত ওই ফুটফুটে মেয়ের জন্য। চ্যাংড়া বললো "এ আর এমন কি? ওই ওষুধের দোকানটা থেকে সুযোগ বুঝে নিয়ে আসছি।" বলেই তড়িঘড়ি উড়াল দিল চ্যাংড়া। আমরা দুজন জানলার কাছে গেলাম ভেতরে উঁকি দিতেই দেখলাম ফুটফুটে মেয়ে মেঝেতে কুঁকড়ে শুয়ে ভীষণ কোঁকাচ্ছে যন্ত্রণায় আর কেঁদেই চলেছে। ওর পায়ের তলা দিয়ে এখোনো রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আমরা ভীষণ অসহায় বোধ করতে থাকলাম। আমাদের অস্থিরতা দেখে আরও জনা তিনেক পাতি এগিয়ে এলো এইদিকে। যতোটা পারি বোঝালাম ওদের। রোগামতোন একজন এগিয়ে এসে জানলা দিয়ে ঘরটা দেখে নিল ভাল করে তারপর বললো, "দেখে মনে হচ্ছে একটা মাত্র ঘরেই থাকে ওরা। ডানে একটা লাগোয়া গোসলখানা। উল্টোদিকে বেরুনোর দরজা। দরজাটার ওপর ঘুলঘুলি মতোন আছে। ওইদিক দিয়ে আলো ঢুকছে ঘরের ভেতর। তার মানে দরজার ওপাশে একটা খোলা জায়গা আছে।" পাতিটা রোগা হলে কি হবে, বুঝলাম বেশ বুদ্ধিমান। এই দূঃসময়েও ওর বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারলাম না। সবাই মিলে ঠিক করলাম দরজার উল্টো দিকের খোলা জায়গাটা খুঁজে বের করতে হবে। পাঁচজন মিলে পথ খুঁজতে শুরু করলাম। কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পেলাম না। জানলার কাছে গিয়ে ফুটফুটে মেয়েকে বারে বারে ডেকে ডেকে বলতে লাগলাম "ওঠো গো মেয়ে ওঠো। খুঁজে দেখো ঘরে কোন ওষুধ আছে কি না। আর দ্যাখো কোনভাবে দরজা ভেঙে বেরুতে পারো কি না। শুধু কেঁদে কেঁদে কোন লাভ নেই। ওঠো গো মেয়ে ওঠো।" কিন্তু কোন লাভই হলো না। আরও পরে চ্যাংড়া মুখে করে কি একটা সবুজ রঙের ওষুধ নিয়ে এলে আমি তা সাবধানে ছুঁড়ে দিলাম ভেতরে। কিন্তু মেয়েটা যেন তা টেরই পেল না। আরো কয়েক দফা দরজার ওপাশের খোলা জায়গাটা খোঁজাখুঁজি করে আমরা সবাই ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। ফুটফুটে মেয়েকেও ডাকলাম বহুবার। কিন্তু সে হয়তো কিছু আর শুনতেই পাচ্ছে না। যন্ত্রণায় মূর্ছাই গেছে হয়তোবা। সবাই মিলে শেষে ওই কার্নিশের ওপরই বসে রইলাম। সন্ধ্যা নামার একটু পর কিপ্টে ঝিঙে ফিরলো। কিন্তু আজ রিকশা নিয়ে ফিরেছে একেবারে বাড়ির দোরগোড়ায় আর নেমে ভাড়া মিটিয়ে হাতে মালবোঝাই দুটো বড় বড় চটের ব্যাগ নিয়ে ঢুকে পড়লো বাড়ির ভেতর। কিছুক্ষণ পরেই ঘরটায় আলো জ্বলে উঠলো আর কিপ্টে ঝিঙে এগিয়ে এসে বন্ধ করে দিল জানলাটা তারপর ভারি মরিচা ও সবুজ রঙের পর্দাগুলোও টেনে দিল। আমরা ঠায় বসে রইলাম কার্নিশের ওপর আরো অনেক্ষণ। তারপর যার যার ঘরেও ফিরলাম পালা করে করে আর সারা রাতই পালা করে করে করুন আর্তনাদ করে চললাম নিদারুণ অসহায়তায়। আমাদের আর্তনাদে গলা মেলালো তল্লাটের কয়েকটা রাস্তার কুকুরও।
পরের দিন না খুললো জানলাটা, না বেরুলো কিপ্টে ঝিঙে। আমরা উদভ্রান্তের মতো বাড়ির চারদিকে উড়ে বেড়ালাম। তিনটে কুকুরও দৌড়ে বেড়ালো আর আর্তনাদ করে বেড়ালো আমাদের সাথে সাথে। আরও জনা দশেক পাতি জুটলো সাথে সারাদিন। রাতটাও কাটলো আগের রাতের মতোই।
আজ খুব ভোরে ভোরে কিপ্টে ঝিঙে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে পরপর দুদিন লাপাত্তা থাকার পর। আমরা কজন ওকে তাড়াই করেছিলাম কিন্তু শয়তান লোকটা ছুটতে ছুটতে ঠিক চোখের আড়ালে চলে গেল কোথাও একটা অন্য গলি ধরে আর তারপর বড় রাস্তায় একটা বাসেও উঠে পড়লো। বেলা একটু বাড়তেই এক বুড়ো চড়ুইকে পাওয়া গেল যে আগে থাকতো এই বাড়িটাতেই। সেই বুদ্ধিমান পাতিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল দরজার ওপাশের খোলা জায়গাটাতে। ঘুলঘুলিতে চোখ রেখে ওরা দেখলো ভেতরে অন্ধকার। ঘুলঘুলি দিয়ে যতটুকু আলো ঢুকছে তাতে ঠাওর করলো মেয়েটা শুয়ে আছে বিছানায় দরজার দিকে পা দিয়ে। বুড়ো চড়ুইটা ঘুলঘুলি দিয়ে ঢুকে মেয়েটার কাছে গেল আর বেরিয়ে এসে জানালো ফুটফুটে মেয়ে বেঁচে আছে এখোনো। তবে কতোক্ষণ বেঁচে থাকবে তা বলা মুশকিল। অল্প আলোয় যতোটা বুঝেছে ওর শরীর বিবর্ণ হয়ে গেছে আর পায়ের তলায় পচন ধরেছে।
আমরা জনা শতেক পাতি কাক, জনা বিশেক চড়ুই, জনা দশেক পায়রা, জনা বারো কুকুর, জনা পাঁচেক বেড়াল, জনা পঞ্চাশেক নানান জাতের ইঁদুর আর অসংখ্য তেলাপোকা, ছারপোকা, উইপোকারা সবাই মিলে আজ ঘিরে ফেলেছি, ছেয়ে ফেলেছি এই পাঁচতলা বাড়িটা। আজ ছিঁড়ে ফেলবোই এই টানা তারগুলো, যেভাবে পারি ভেঙে ফেলবো তালা দেয়া দরজাটা। ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেবো দেয়ালগুলো। আমরা আর্তনাদ করে যাবো, করেই যাবো। মানুষের কানে আজ পৌঁছে দেবোই গোঙ্গা মেয়েটার আর্তনাদ। জানিনা কিভাবে পারবো, কিন্তু ফুটফুটে মেয়েকে বাঁচাতেই হবে।