Wednesday, May 19, 2021

টুকরো কথা : মতিঝিল

আজ দুপুরে প্রায় পাঁচ বছর পর মতিঝিল চত্ত্বরে গেলাম। গিয়ে মনে হলো পাঁচ বছর বেশ লম্বা সময়, কারন অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা ফাঁকা থাকার কারনেও মনে হতে পারে অবশ‍্য। ছোট বেলায় মতিঝিলের শাপলাটার পাশ দিয়ে যখন যেতাম দুচোখে অদ্ভুত বিষ্ময় মিশে থাকতো আমাদের... এত্তো বড় শাপলা! এত্তো সুন্দর! আমরা কেনো ঠিকঠাক আঁকতে পারিনা, ভেবে একটু মনও খারাপ করতাম। ছোটবেলার সেই চোখ সেই মন হারিয়ে গেছে কিংবা হয়তো মরেই গেছে কবে।


বাসার সামনে থেকে একটা রিক্সা নিলাম। এই কোভিড মহামারিতে রিক্সা করে ঢাকায় ঘোরা বেশ শান্তির আর তাছাড়া দুপুরের ঠাঠা রোদে মগজটাও তাঁতিয়ে নিলাম একটু বহুদিন পর। তবে যতোটা ভেবেছিলাম ততোটা শান্তির ভ্রমণ হতে হতেও হলো না। ফাঁকা রাস্তা পেয়ে লোকাল বাসগুলো তো বেপরোয়া ছুটছেই আর তারচেয়েও বেপরোয়া রিক্সাগুলো। ট্রাফিক পুলিশদেরও যেন একটু গা ছাড়া বন্ধু বন্ধু ভাব। রমনার পাশ দিয়ে যেতে যেতে মনটা হুহু করে উঠছিল... আহা... প্রিয়তম রমনা... কতো ভোরের অবারিত প্রশ্রয়। রমনায় এখনো একটু পর পর ইট, শুড়কি আর বালুর স্তুপ, কাজ চলছে কয়েক বছর হয়ে গেল, এই মারিতে কাজটাজ সব শেষ হয়ে গেলে বাঁচোয়া। যতদুর পারলাম দেখে নিলাম রমনা পথ চলতে চলতেই... এতো ফুল ফুটে আছে গাছে গাছে আর মরার কোকিলের উচ্চ তারঙ্গিক ডাক এখনো চলছে। হাইকোর্টের উল্টো দিকে এতো বড় বড় সোনাইল  আছে আগে খেয়ালই করিনি কোনদিন। সবে ফুল ফুটছে কিছু ঝুমকো থোকায়। আর কিছুদিন পর সম্পুর্ণ ফুটন্ত গাছগুলোকে দেখতে যেতে হবে। কৃষ্ণচুড়াগুলোতে এখনো আগুন ধরে আছে। দুজন কম‍্যুনিটি পুলিশকে দেখলাম আঁকশি দিয়ে কাঁচা আম পাড়ছে, আমি ওদের দিকে মনোযোগ দিতেই একজন যেন একটু লজ্জ্বাও পেলো। আইল‍্যান্ডের বাগান বিলাসগুলো এতোদিনে ভালোই ঝাঁকড়া হয়ে উঠেছে। সত‍্যি বলতে পুরো শহর জুড়েই নানা রঙের নানা পরতের বাগান বিলাস। ওদের দেখলে মনে মনে বলি 'জানো তো, তোমাদের নাম রেখেছে স্বয়ং রবিন্দ্রনাথ!' মানুষ ছাড়া সবাই নিজেদের সম্মিলিত নাম পরিচয় নিয়ে জন্মায়, বাঁচে, মরেও যায়। আমরা মানুষেরা নিজেদের আমিত্বের তাগাড় খেয়ে খেয়ে সহজ সরল বেঁচে থাকার সৌকর্য যেন হারিয়েই ফেলি। হাইকোর্ট পেরিয়ে বাঁয়ে মোড় নিয়ে কিছু যেতেই রাস্তা এবড়ো থেবড়ো আর সরু হওয়া শুরু। মেট্রো রেলের কাজ চলছে। তা চলুক। মেট্রোটা চালু হলে যদি শহরটা একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এদিকটায় গাছপালা তেমন আর চোখে পড়ে না। পাল্লা দেয়া উঁচু উঁচু নতুন পুরাতন সব দালান, কর্মব‍্যস্ত যুদ্ধংদেহী  মানুষজন (যদিও এখন সংখ‍্যায় অনেক কম), এই মানুষদের মুখগুলো, চোখগুলো আজও আগের মতোই তেড়ে তেড়ে আসতে থাকলো টিকে থাকার রুঢ় বাস্তবতায় ভর করে। দিলকুশায় তপ্ত দুপুরে  ঠান্ডা ফোয়ারা আর উর্ধ্বমূখী বকেদের ঘনিষ্ঠতা আছে ঠিক আগেরই মতোন। এই ব‍্যস্ততম অফিস পাড়ায় ডানে বাঁয়ে এদিক সেদিক চিপা চাপা গলি। ওখানে রকমারি চা খেতে থাকা আর সিগারেট ফুঁকতে থাকা আপাত সুখে অলস কিন্তু বাস্তব রসবোধ সম্পন্ন লোকেদের কথায় কান পাতলে রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক হাল হকিকত, ব‍্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতি আর তাদের মধ‍্যে সম্পর্কই বা কি, তার একরকম উচ্চমার্গীয় ধারনা ওদের প্রচলিত চিন্তাশীলতার ভাষায় পাওয়া সম্ভব। 


আরও একটু এগিয়েই শাপলা চত্ত্বর, বহু বছর পর সেই উন্মুক্ত চত্ত্বরে এসে পড়লাম আবার। এর ডানে বাঁয়ে বড়রাস্তার দুধারে বেশ কিছু নতুন নতুন ভবন, খাবার দোকান আর হালের চাইনিজ মার্কেটও চালু হয়ে গেছে। পুরোনো ভবন, পুরোনো খাবার দোকান, পুরোনো মার্কেট, পুরোনো সিনেমা হলগুলোও আছে বেশ কয়েক যুগের সাক্ষী হয়ে। হকাররা অবশ‍্য পুরো শহরের মতোই এখানেও কম। এই রাস্তা ধরে যেতে যেতে হঠাৎ দেখি একটা নির্দিষ্ট আকাশের নিচে শহুরে সোয়ালো পাখিদের এলোমেলো চঞ্চল ওড়াউড়ি। নতুন, আধুনিক, পরিবেশ বান্ধব অট্টালিকাগুলো দেখে উচ্ছসিত ছিলাম কিন্তু মুহুর্তেই মন খারাপ হয়ে গেলো। ভাবলাম সব পুরোনো ভবনগুলো যখন ভেঙ্গে ফেলা হবে, এই পাখিগুলোর কি হবে? ওরা কি করে ঘর বাঁধবে কাঁচের মসৃণ দেয়ালে? সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে অভিযোজন করতে করতে ওরা রুক্ষ কর্কশ শহরেও মানিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু এখন? থাক। আর ভাবতে চাইনা। যা হবার তা হবে। প্রতি বর্গফুট সোনার দামে বিকোয় এখানে, পাখিদের কথা কবে কোথায় কোন বাণিজ্যনীতি ভেবেছে মানুষের পৃথিবীতে? তারচেয়ে গায়ে গা ঘেঁষে থাকা ভবনগুলো পেরিয়ে বহুকাল পর এখোনো যে গাঢ় সবুজ বর্ষীয়ান মেঘশিরিষগুলোর ফাঁকে ফাঁকে পরিস্কার রৌদ্রজ্জ্বল হালকা নীল আকাশটা দেখতে দেখতে ফিরছি বরং এই ছবিটাই ভর করে থাকুক মাথায়।


মেঘশিরিষরা মাথায় ভর করে আছে ঠিকই কিন্তু ওই সোয়ালোদের ওড়াউড়িটা কিছুতেই চোখের সামনে থেকে যাচ্ছে না।

আশ্চাইয‍্য!!!



No comments:

Post a Comment

English Translation of Bangla Folk Song: Fakir Lalon Shah; চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি; Forever I Nurtured a Mysterious Bird

 Forever I Nurtured a Mysterious Bird Forever I nurtured a mysterious bird, which never discloses its identity. For this grief, my eyes ...