সেই কোন শৈশবে দুর্গাপূজা দেখতে গিয়েছিলাম প্রথম মনে করতে পারবো না ঠিক। বাবা নিয়ে গিয়েছিল আমাদের ভাইবোনদের। আজো দুর্গাপুজা এলে সেই প্রথমবারের দুর্গাদর্শণই চোখে ভেসে ওঠে। সেই সুডৌল দশ হাতের দুর্গা, তিনটে চোখ, লাল টকটকে শাড়ি, ইয়া বড় হাঁ করা সিংহ, অনেক আলো, অনেক মানুষ, অনেক শব্দ তালের আবার আনেক শব্দ তালের নয়, হৈহৈ রৈরৈ, ধোঁয়া, অদ্ভুত সব গন্ধ, ধুপের, কর্পুরের, ফুলের, মানুষের... সব মিলিয়ে অচেনা অদ্ভুত এক জগত যেন। ছোট্ট আমি বাবাকে আরও জোরে চেপে ধরেছিলাম হারিয়ে যাবার ভয়ে। হৈ হট্টোগোল পেরিয়ে তারপর গিয়েছিলাম বাবার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর বাড়ি। বাড়ি নয়, সে ছিল এক ছোট্ট ব্যাড়ার ঘর, গ্রামে যেমন থাকে তেমন। সে ঘর গ্রামে নয়, ছিল শহরের ঠিক হৃদয়েই। প্রায় অন্ধকার সে ঘরের এক কোণে ছিল এক দাদু, সাদা ধবধবে শাড়িতে মোড়ানো। উনি ছিলেন বাবার আরেক মা ই, জেনেছি সব সময়, বাবার চরম দূঃসময়ে নাছোড় অভাবের মাঝেও ওই দাদুটাই নাকি পাশে দাঁড়িয়েছিল। জেনেছি ওরা সেই পুরো এলাকার জমিদার, দুষ্টু লোকেরা কেড়ে নিয়েছে, জবরদখল করেছে ওদের সবকিছু। পূজার মিষ্টি, ফল আর স্প্রাইট খেয়েছিলাম আমরা ওখানে। প্রতি বছরই যেতাম ওই মিষ্টি দাদুটার বাড়ি, তারপর বড় হতে হতে কখন থেকে যে আর যেতাম না তা মনে নেই। লক্ষ্মীপূজোতে যেতাম বাবার দুই সহকর্মীদের বাড়ি। এতো ঝকঝকে থাকতো ওদের মেঝে, ঘরদোর, আসবাব, জুতো খুলে চৌকাঠ পেরোতাম আমরা। কর্পুরের সুগন্ধি ভরা ঘরে তৈরী সন্দেশ, আরো কতো কি খেতে দিতো ওরা। আদরও পেতাম অনেক ওখানে গেলে। স্কুলে ভর্তি হবার পর প্রিয় বন্ধু হলো শুক্লা, অনেকটা আমার মতোই দেখতে, কালো গায়ের রঙ, সরু সরু হাত, ফোলা ফোলা গাল, টানা টানা চোখ, সিল্কি সিল্কি চুল, মনে হতো ওই আমার সত্যিকারের বোন যেন, প্রাণের বন্ধুও যেমন। কতো যে গল্প করতাম, খেলতাম দুজন একসাথে। স্কুলের ঠিক পেছনেই ছিল ওদের বাসা। শুক্লা সবসময় বলতো "চলো না, চলো আমার বাসায়।" একদিন সত্যি সত্যি চলেও গিয়েছিলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠলাম দোতলা বা তিনতলায় যেন, সিঁড়ি থেকে বাঁদিকে ওদের বাসার দরজাটা খোলাই ছিল। চৌকাঠ পেরিয়ে পা রাখার সাথে সাথেই শুক্লার মা হাঁ হাঁ চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুললো, আমি নাকি ওদের বাসা নোংরা করে দিয়েছি, এখন পুরো বাসা মুছতে হবে আবার। আমি আর শুক্লা দুজনেই ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। আমি আতঙ্কে একছুটে আবার স্কুলে ফিরে এলাম। খুব দূঃখ, খুব কষ্ট, খুব যন্ত্রণা আর খুব রাগ হয়েছিল সেদিন আমার, ভাবছিলাম, সবাই ঠিকই বলে "হিন্দুরা খুব খারাপ, ওরা সত্যিই খুব শয়তান"। শুক্লার সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে গেল আমার। হিন্দুদের প্রতি ঘৃণা হলো আমার। পাড়ার পাতি উচ্চিংড়ে ভাইয়েরা যখন কাগজ পোড়াতে পোড়াতে বলতে লাগলো "হিন্দুদের মন্দির পোড়াই, হিন্দুদের মন্দির পোড়াই", আমিও যোগ দিলাম ওদের সঙ্গে। কারন, হিন্দুরা খুব বাজে, ওরা বাবুরি মসজিদ ভেঙেছে, ওরা মুসলমানদের ঘেন্না করে। আমার বয়স তখন পাঁচ কি ছয়, কিংবা সাত, ঠিক মনে নেই।
আমি সেই ভাগ্যবানদের মধ্যে একজন, যার একজন প্রগতিশীল বাবা ছিল, সুশিক্ষা লাভের সুযোগ হয়েছিল, বিভিন্ন ধর্ম ও বিশ্বাসের বন্ধুবান্ধব তৈরী হয়েছিল, অসাম্প্রদায়িক ও আধুনিক পরিমন্ডলে জীবনযাপনেরও সুযোগ হয়েছিল। তাই হয়তো বড় হবার পর সাম্প্রদায়িক চিন্তা আর মাথা চাড়া দেবার চেষ্টা করেনি। পরবর্তীতে এক বেস্ট ফ্রেন্ডের মা যখন ক্ষেপে উঠেছিলেন আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব দেখে শুধুমাত্র আমি মুসলিম পরিবারের একজন বলে, তখনও না। আমি বুঝতে শিখেছিলাম ওই আন্টিটা সাম্প্রদায়িক চিন্তা করেন বলেই ক্ষেপে উঠেছেন, এ ওনার ব্যক্তিগত কুশিক্ষা এবং কূপমন্ডুকতা, এর সাথে আমাদের বন্ধুত্ব এবং আমার অসাম্প্রদায়িক চিন্তা ভাবনার কোন সমান্তরাল সম্পর্ক নেই। সবকিছু ছাপিয়ে মঞ্চে শিল্পময় মন্ত্রজপ যেমন করেছি, শাড়ি পরে কৈশোরের ওপারেও পা রেখেছি সরস্বতি পূজায়, কিংবা ঢাকের তালে নেচেছি উন্মাতাল কখনো, তেমনি সব ধর্মের বন্ধুদের সাথে ভাগ করে নিয়েছি ঈদের খুশি, শবই বরাতের আলো ও স্বাদ কিংবা মহররমের বিষাদ।
সময়ের অগ্র যাত্রায় আমিও পেরিয়েছি অনেকটা পথ। দৃশ্যমানে হয়তো নয়, অদৃশ্য মনটাকেই চেয়েছি এগিয়ে নিতে, এগিয়ে দিতে, সর্বক্ষণ। কোন ধর্মীয় আচার আর টানে না আমাকে। এক ধরনের স্মৃতিপ্রবণতার আবেগ আপ্লুত করে খানিকটা যদিও, অস্বিকার করবো না। কিন্তু ধর্মীয় আচারগুলোর মূলের ইতিহাস, সমাজ চিন্তা কিংবা বিশ্বাসের পশ্চাতপদতা পীড়িত করে আমাকে। যে ধর্ম ও আচার মানুষে মানুষে বিভেদ করে, নারীপুরুষের বৈষম্যতাকে যুক্তি দেবার প্রয়াস করে, লোভান্ধ করে, মোহান্ধ করে, সে ধর্মে, সে আচারে, সে বিচারে মন নেই আমার। নারীর শরীর ও জীবনযাপন নিয়ে কোন বিধি নিষেধের ঘোর বিরোধী যেমন আমি, নারীবাদী কিংবা মানবতাবাদী হবার জন্য দুর্গার মাঝে আমি নারীশক্তির রূপ দেখতে চাইনা, ভাবতে চাইনা নারীও দুর্গার প্রতিরূপ। মাদুর্গা আমার কাছে অন্য আর সব সুপারহিরোদের মতোই মানুষের অসামান্য কল্পনাশক্তির এক অনবদ্য সৃষ্টি। যেকোন নারীকে এবং যেকোন পুরুষকেও আমি খুব সহজ ও স্বাভাবিকভাবে শক্তিমান বলে স্বীকার করতে চাই, তার সমস্ত যোগ্যতা, অযোগ্যতা, সবলতা, দূর্বলতা, সফলতা, ব্যর্থতা কিংবা অনিশ্চয়তা নিয়েই।
এই সবই আমার নিজের একান্ত বিশ্বাসের এবং অভিজ্ঞতার পরিলেখা মাত্র। আশা করি কারো ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিয়ে ফেলিনি, এমনটা আমি স্বপ্নেও করতে চাইনা। আমি যেমন আমার বিশ্বাস নিয়ে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করতে চাই তেমনি চাই প্রত্যেকেই যেন যার যার বিশ্বাস অনুযায়ী জীবন যাপন এবং উদযাপন করতে পারে। হিংসা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমরা যেন দাঁড়াতে পারি আমাদের সহজাত বিশ্বাস ও উপলব্ধি নিয়েই। নিজের কুশিক্ষা এবং কূপমন্ডুকতার বিরুদ্ধেও যেন দাঁড়াতে পারি নিজেরই নাজুক কোমল মানুষের হৃদয় নিয়ে।
জানি সেদিন খুব ছোট্ট ছিলাম, খুব রাগ হয়েছিল, রাগে অন্ধ হয়েছিলাম, শুক্লাকে ত্যাগ করেছিলাম। কিন্তু আজও ওর ছোট্ট মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে মাঝেমাঝে, ওখানে অনেক লজ্জ্বা ছিল, কান্না ছিল, ওর মায়ের ধর্মান্ধতা ওকে সেদিন খুব ছোট করে দিয়েছিল। শুক্লা এখন কোথায় আছে, কেমন আছে, কেমন হয়েছে দেখতে, কিচ্ছু জানিনা। পৃথিবীর সমস্ত বিভেদের, সমস্ত নীচতার অনেক ঊর্ধ্বে ছিল আমাদের বন্ধুত্ব। এটা যখন বুঝেছি তখন অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল হয়তো। আর যেন কোন মানুষের, কোন সমাজের, কোন রাষ্ট্রের দেরী না হয়। আমাদের দেরী হলে পিছিয়ে যায় পৃথিবী অন্ধকারে।
No comments:
Post a Comment