Monday, January 11, 2021

ইউফোরিয়া (দুই)

আমার প্রিয় চট্টগ্রাম শহরটা কখন যে এতো দুঃখের শহর হয়ে গিয়েছিল বুঝেও যেন বুঝতে পারিনি। শহরটাকে অনেক বেশিই ভালবাসতাম কিন্তু তারপরও একদিন ঠিক করলাম সব ছেড়েছুড়ে পালাব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আর তাই করলাম। ছেড়ে আসার সময় আর তো কিছু ছিলনা আমার নিজের তাই নিজের মাথার চুলগুলোই দক্ষিণা দিয়ে এলাম শহরটাকে। নতুন শহরে মনের মতোই একটা আস্তানা খুঁজে পেলাম। ইন্সটিটিউটের লোকেরা হয়তো একরকম বাধ‍্য হয়ে আস্তানা গাঁড়তে দিয়েছিল। আমি যখন ওদের বললাম আমাকে থাকার জায়গা না দিলে আমি ভর্তিই হবোনা তখন ওরা আমার অযাচিত অহংকার ও ঔদ্ধত‍্য দেখে হাঁ হয়ে গেল। কিন্তু ডিজি কি বুঝলো কে জানে থাকার জায়গা দিল। ওখানে এক অন‍্যরকম জীবন শুরু হলো। একদম শুধু নিজের সাথে নিজের একান্ত জীবন। প্রতিদিন বিকেলে বেরিয়ে পড়তাম শহর দেখতে পায়ে হেঁটে, কি দেখতাম কে জানে, মাথাটায় ভীষণ রকম একটা চাপ অনুভব করতাম আর বুকের ভেতরটা ভয়ে ধুকধুক করতো। যাই হোক ততোদিনে আমি অনেক সাবধানি হয়ে গেছি আর বহু বছর ক্লাসের বন্ধুরা যে আমাকে দুধভাত গণ‍্য করতো ভাবলাম তার শোধ তোলা যাক। ক্লাসে প্রথম আলাপেই সবাইকে বল্লাম হে সহপাঠিগণ আমি তোমাদের জ‍্যাষ্ঠা ভগিনী এবং পরম ভক্তিশ্রদ্ধা কামিনী। কি বুঝলো কে জানে, ওরা সবাই একশ হাত দূরে দূরে থাকতে শুরু করলো। ভালই হয়েছিল কারন আমি একটা নির্জন জীবন চেয়েছিলাম। শহরে ঘুরতে ঘুরতে একদিন এক পূর্বপরিচিত শিল্পীর সাথে দেখা। ওকে দেখে আমি পুরো আঁতকে উঠলাম। হায় হায় এ কি অবস্থা! পুরোই হাড় জিরজিরে অবস্থা, ময়লা জামা কাপড়, ময়লা শরীর, ভয়ংকর দূর্গন্ধ আসছে গা থেকে। সবচেয়ে বড় কথা মানুষটা কি এক দূর্বিসহ ভয়ে আতংকে সংকোচে পুরো গুটিয়ে আছে। গেলাম ওর আস্তানায়। এমন ভাবেও মানুষ বাঁচে দেখে শিওরে উঠেছিলাম। শুধু একটু খাবার পেলেই মানুষের বুঝি প্রাণ আর খাঁচাছাড়া হয়না! হায় প্রিয়তম প্রাণ এ কেমন নাছোড়বান্দা তুমি? ওই ঘর নামের নোংরা আস্তাকুঁড়টাতেই যেন আমি নিজের অস্তিত্বটাই দেখতে পেয়েছিলাম সেদিন। হুম। কি যেন ভেবে ওর সাথে থাকতে শুরু করলাম, প্রথমে মাঝেমধ‍্যে তারপর তল্পিতল্পা সহ এসে উঠলাম এই নতুন আস্তানায়। সব ধুয়ে মুছে সাফ করতে চাইলাম, করেছিলামও হয়তো, যে ময়লা দেখতে পাওয়া যায় তা আর যে ময়লা দেখতে পাওয়া যায়না তাও। কিন্তু ধুলো আর নোংরা এই শহুরে জীবনে এমনই, যত আমরা দূর করতে চাই ততো যেন আরও কোথা থেকে উড়ে উড়ে এসে ঘাঁটি গাঁড়ে। ওর একদিন মনে হল আমি নাকি ছিনিয়ে নিতে এসেছি ওর সবকিছু, এতো অবাক লেগেছিল শুনে, কি ছিনিয়ে নেব আমি? কি ই বা আছে ওর কাছে? ও যেদিন আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিল আবার শহরটা অনেক ঘুরেছিলাম। অনেক আর অনেক রাত পর্যন্ত আর অনেকদিন পর্যন্ত। পায়ে হেঁটে নয়, রিক্সায়, অতোটা শক্তি পেতাম না তখন আর। 


আমি সবসময়ই ভাগ‍্যবানদের দলেই কিভাবে জানি ভিড়ে যাই। চাকরির পোস্টিং পেয়ে গেলাম গুলশানে। শহরের এই অংশটা ভীষণ ঝাঁ চকচকে, অনেক আলো থাকে চব্বিশ ঘন্টা। সহকর্মীরা যারা আগে বাঁকা চোখে তাকাতো ওরাও এসে বলতো, আপনাকে এখানে দারুন মানাচ্ছে। নিজেকে ঝাঁ চকচকে সাজিয়ে নিতে আমি অনেক ছোট থাকতেই শিখে গিয়েছিলাম নানান প্রতিকুলতার মধ‍্যে। কিন্তু একদিন একটা মেয়ে কলিগই যখন অতগুলো ছেলে কলিগের সামনেই আমাকে বলে বসলো "ওই লোকটার (জানিনা আর কোনদিন জানতেও চাইনি ঠিক কার কথা বলছিল) কোন দোষ নেই সে যদি দিনরাত তোমার কথা ভাবে। ওনার যদি নিজের বউকে আর ভাল না লাগে এটা ওনার দোষ নয়।" আমার ছেলে কলিগগুলো একটু থতমত খেয়ে গেলেও সেদিন ঝটপট প্রসঙ্গ টেনেছিল সেদিনের আবহাওয়া, ক‍্যাফের ক্রমনিম্নগামী চায়ের দিকে কিংবা কেউ হয়তো একটা নতুন জোকই বলছিল। ওরা শেষ দিন পর্যন্ত আমার পাশে ছিল। একদিন ওরা মজা করছিল আমার সাথে, বলছিল এবারের ফায়ার ড্রিলে আমাকে ফেইন্ট কলিগ বানানো হবে আর কোলে করে নামানো হবে এই আটতলা থেকে, আমি শুধু বেছে নিতে পারবো কার কোলে উঠবো। আমি যখন একে একে সবাইকেই বাতিল করছিলাম একজন ক্ষ‍্যাপার ভান করে জিজ্ঞেস করলো "তুমি নিজেকে কি মনে কর? ঐশ্বরিয়া?" চেহারা সুরুত নিয়ে এত্তোবড় বাঁশ দেবে বলে এত্তো নাটক! ওরা অনেক মজা করতো, কেউ গান গেয়ে উঠতো "তাহমিনা...আহ মিনা... এ... এ..." কিংবা সিসিক‍্যাম এড়িয়ে হয়তো দেখাতো কোন ডান্সমুভ। আসলেই আমি নিজেকে কি ভাবতাম, ভাবি, আমি নিজেকে ওদের প্রিয় কেউ ভাবতাম যে ওদের সত‍্যি সত‍্যি ভালবাসতো কারন ওরা ওই ভীষণ প্রতিযোগিতামূলক জায়গাটাতেও নিজেকে ভালবাসতে শিখিয়েছিল। 


দুহাজার সতেরোতে যখন আমার সেলিব্রেটি ক্রাশ ছিল জিইযি তখন একদিন হঠাৎ জিমে গিয়ে পায়ের নিচটা ফাঁকা হয়ে গেল আর মনে হল এখনই মাথা ঘুরে পড়ে যাব। হুবুহু জিইযির মতো দেখতে একজন আয়নার সামনে ওয়ার্কআউট করছে। সেই হাইট, সেই শরীরের গড়ন, সেই গায়ের রং, সেই চোখমুখ, সেই হেয়ারস্টাইল, গায়ের টিশার্টটা আর হাতের ব্রেসলেটটাও যেন একই। প্রথমে ভাবলাম মাথাটা পুরোপুরি গেছে। কিন্তু দেখলাম না আরে এ একেবারে ফটোকপি। এর কন্ঠটাও জিইযির মতো, হাঁটে চলে আর তাকায়ও জিইযির মতোই। আমি একরকম ধরা পড়ে যাওয়ার আতংকে একশ হাত দূরে দূরে থাকতে লাগলাম, বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছে এইসব! জীমও মিস দিলাম কদিন, ভাবলাম মাথাটা ঠিক হোক, আজকাল ভুলভাল দেখছি নিশ্চিত। না মাথাটা ঠিকই ছিল। এর পরেও সবসময় ওকে একইরকমই দেখেছিলাম। নিজেকে বোঝালাম এ শুধু জিইযির মতো দেখতে জিইযি তো নয় থোড়াই।


এরই মধ‍্যে এক বিদেশি ছোকরার সাথে আলাপ জমে উঠলো। আমার চেয়ে দুবছরের ছোট আর বাংলাদেশে এসেছিল একটা পেশাগত কাজে। এখানে বলতে গেলে কথাই হয়নি তেমন কিন্তু নিজের দেশে ফেরার পর থেকে সেই যোগাযোগ করতে শুরু করলো। প্রথমে পাত্তা দিচ্ছিলাম না। কিন্তু ওর জীবন বোধ আর সংগীত চিন্তা আর গায়কী আমাকে আকর্ষণ করলো। ও র‍্যাপ করে দারুণ আর দারুন মেলোডি স্কিলও আছে। পাগলটা রাতদিন এতো এতো ভয়েস ম‍্যাসেজ পাঠাতে লাগলো। কিছু কিছু বাংলাও শিখতে লাগলো। আইয়ুব বাচ্চুর সেই তুমি আর বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পর্যন্ত গেয়ে পাঠিয়েছিল। কিন্তু একদিন ও ঠিক করলো ওর বউকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে আর অন‍্য দেশে নতুন জীবন শুরু করবে। আমার ভীষণ রাগ হলো, আমি ভাবতেই পারছিলাম না ওর দেবশিশুর মতো বাচ্চাদুটো ওর বুকের ওপর খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়তে পারবেনা আর। ইচ্ছে করেই দিলাম ওকে ক্ষেপিয়ে আর ব্লকও করে দিলাম। দুহাজার কুড়ির জানুয়ারিতে  শেষ জেনেছিলাম ওর স্ত্রীর সাথে পুরোপুরি ডিভোর্স হয়ে গেছে। এই ভারতীয়দের সাথে ওদের অনেক পার্থক‍্য হয়তো, কিংবা... জানিনা আসলে, কিছু জিনিস কেন এখনো মেনে নিতে পারিনা আর বাবা চলে যাবার পর থেকে আমি হয়তো একটু বদলেও গেছি। 


আমার কিছু বন্ধুরা ওদের বরের কিংবা প্রেমিকের ব‍্যাপারে এতোটাই পসেসিভ যে কেমন অবিশ্বাস নিয়ে তাকায় কিংবা হঠাৎ হঠাৎ খুব খারাপ ব‍্যবহারও করে ফেলে ভুল বুঝে। বোকা মেয়েগুলো হয়তো ভুলেই গেছে কতোবার নিজের ক্রাশকেও রাতারাতি ভুলে যেতে চেয়েছি আর গেছিও শুধু ওদেরই জন‍্য। আর না গিয়েও উপায় ছিলনা কখনো কারন ওরাই ছিল সবসময় সুন্দরী আর যোগ‍্যতর। আর আমি এখন আর কাউকে ভাল লেগে গেলেও আগের মতো বোঝাই না বরং একটু ভয়েই কুঁকড়ে থাকি।  কারন সেই ভাললাগার মানুষটা হয়তো ভীষণ বিরক্তই হবে আর এক নাছোড়বান্দা ঘৃণাই প্রকাশ করবে, হয়তো সেই ঘৃণা সরাসরি প্রকাশ করতেও তার ঘৃণাই হবে তাই অন‍্য কারো মাধ‍্যমে সেই বিরক্তি ও ঘৃণা পৌঁছে দেবে। আমার বন্ধুরা যে রেগে যায় ওদের বর কিংবা প্রেমিকের সাথে কেউ হেসে কথা বললে এটাকেই হয়তো নিখাদ ভালবাসা বলে। সবসময় সমীকরনগুলো এতোটাও সরল হয়না। দেবদারুগুলোকে দেখিনি আজ ষোল বছর। কেমন আছে বা এখনো আদৌ আছে কি না কে জানে? সবসময় ওদের কথা মনেও থাকেনা। এতো হাজার ব‍্যস্ততা, হাজারো নতুন দিন আসে, চলে যায়, আবার আসে বোকার মতো, বুদ্ধিমানের মতো কিংবা কোন অচেনা পথচারীর মতো, জীবন সামনেই এগিয়ে যেতে থাকে। 


বুঝলে বোনটি বুঝলে ভায়া

জীবন এক আজব মায়া

সবার ওপর জীবনই থাক

মাথায় বাঁচুক ইউফোরিয়া


https://soundcloud.app.goo.gl/R9cRD










No comments:

Post a Comment

English Translation of Bangla Folk Song: Fakir Lalon Shah; চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি; Forever I Nurtured a Mysterious Bird

 Forever I Nurtured a Mysterious Bird Forever I nurtured a mysterious bird, which never discloses its identity. For this grief, my eyes ...