Sunday, January 10, 2021

ইউফোরিয়া (এক)

"আপা, ওই বাইয়া এটা আপনেকে দিসে" বলে রিক্সাওয়ালাটা দাঁত বের করে একটা খাম এগিয়ে দিয়েছিল। আমি হাই তুলতে তুলতে বলেছিলাম "আপনার কাছেই রাখেন। আর প্লিজ তাড়াতাড়ি চলেন"। আমার বয়স তখন প্রায় চোদ্দ, এক দেড় মাস পরেই এস এস সি পরীক্ষা। ভোর সাড়ে ছটার বেশি বাজে, কোচিং ক্লাসে যাচ্ছি, ঠিক জানি ওপরে জানলা দিয়ে কেউ না কেউ নজর রাখছে আর সবচেয়ে বড় কথা হলো এতো চিকন চিকন হাত পা ওয়ালা, থ্রি কোয়ার্টার প‍্যান্ট পরা বয়ফ্র‍্যান্ড আমার চাইনা চাইনা চাইনা। টেস্টে ফেল মারলেও শেষ পর্যন্ত আমাকে পরীক্ষা দিতে এ‍্যালাও করা হয়েছিল। ঘরের সবার চিন্তার শেষ ছিল না আমাকে নিয়ে, তারচেয়েও হয়তো নিজেদের মানসম্মান নিয়ে। এরই মধ‍্যে আজ পর্যন্ত আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুদর্শন ছেলেটা ভাব করতে এলো একদিন রাস্তায়, ও সায়েন্সে পড়লেও ইংরেজী ক্লাসে দেখতাম, ঠিক আমার মাথার পেছনে এসে বসতো আর কোনো প্রশ্নের উত্তর দিলে অযথাই হাততালি দিয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করতো। পড়াশুনায় ভাল ছিল নিশ্চিত কারন কলেজিয়েটে পড়তো। কিন্তু কি যে দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় চাপলো যখন ভাব করতে এলো চিৎকার করে করে বলতে লাগলাম "কি বল? কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছিনা। এ‍্যাঁ? কি বলো??? ধুৎ! কিচ্ছু শুনিনা!" মনের দুঃখে নাকি রেগে গিয়ে না কে জানে কেন সেদিনের পর আর ওর চেহারা দেখিনি। তা পরীক্ষা দিলাম মোটামুটি কিন্তু খুব ভাল রেজাল্ট করে বসলাম, পুরো নিরানব্বইটা নৈবৃত্তিক উত্তর ভুল দিয়েও অল্প কিছু নম্বরের জন‍্য স্ট‍্যান্ড পজিশান মিস হয়ে গিয়েছিল। তা যাই হোক কোচিং ঠিক চলছিল কলেজে ভর্তির জন‍্য। এবারে দেখলাম দুটো ছেলে জগিং করছে পাশে পাশে রোজরোজ আর ভাব জমানোর চেষ্টায় আছে। বললো ওরা মেডিকেলে পড়ে। হোস্টেলে থাকে। বললাম, আমি বিশ্বাস করছিনা কারন মেডিকেল হোস্টেলের ছেলেরা কেন শুধু শুধু এতদূরে এসে জগিং করবে। আর যদি করেও এমন আজাইরাদের ব‍্যাপারে আমি নট ইন্টারেস্টেড। 

প্রথম যে একেবারে আয়োজন করে প্রস্তাব দিয়েছিল তার মাথার ঘাম পায়ে পড়েছিল ভ‍্যালেন্টাইনস ডে তে আমার পেছন পেছন ছুটতে ছুটতে। পরে এক মেলার ভীড়ে লালদিঘির মাঠে সে কিভাবে জানি পাকড়াও করে ফেলেছিল। তারপর আমাকে একটা কাব‍্যিক নামে (যেটা শুনে আমি কিছুটা তব্দা খেয়ে গিয়েছিলাম) ডেকে ডেকে অনেক্ষণ ধরে যা বললো তার সারমর্ম হল, তার সামনে পরীক্ষা, আমার জন‍্য পরীক্ষায় ফেল করলে সে মরে যেতে বাধ‍্য হবে আর একমাত্র ছেলে মরে গেলে ওর বাবা মাও মরে যাবে। নিজেকে একটা ভয়ংকর ভিলেন চিন্তা করে এমন দম ফাটানো হাসি পেল আচমকা যে নিজেই প্রচণ্ড অসহায় বোধ করতে লাগলাম, হা হা করে আকাশ বাতাস ফাটিয়ে হাসতে হাসতে প্রথমে পেটে হাত চেপে বসে পড়লাম পরে অবস্থা বেগতিক দেখে ছুটে পালিয়েছিলাম। সেদিন বাসায় ফিরে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এমন নিষ্ঠুরতা আর কোনদিন দেখাবো না। আমাদের কলেজে দিন ভাল কাটছিল। মমতাজউদ্দিনের নাটক করেছিলাম, গান করতাম, কবিতা পড়তাম, ডিবেট করতাম, টুকটাক ছবি আঁকতাম, লিখতাম আর নানান দুষ্টুমিতে মেতে থাকতাম। কলেজের এন‍্যুয়াল প্রোগ্রামে পুরোনো একটা আধুনিক গান গাইবার পর খেয়াল করলাম মাঝেমধ‍্যে কে জানি আশপাশ থেকে সেই গানটাই গাইছে। একজন বললো ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের কেউ একজন ভাবছে এভাবে সে নাকি ইমপ্রেস করতে পারবে। একদিন দুদিন তিনদিনও গেল। চতুর্থ দিন আর মাথা ঠিক থাকলো না "ধর ধর" বলে এমন তাড়া করলাম বেচারা ছুটে পালিয়ে গেল সাথে দুজন বন্ধুও কেন পালিয়েছিল কে জানে। ওরা আসলে ভাবতেই পারেনি যারা রবীন্দ্র নজরুলের এবং হারানো দিনের গান করে তারা এমন ধাওয়াও করতে পারে। পরের বছর ভ‍্যালেন্টাইন্স ডে টা অন‍্যরকম ছিল কারন সব বন্ধুদের দোকা জুটে গেছে শুধুমাত্র আমি আর আমার এক উচ্চিংড়ে বন্ধু (দোস্ত কোনদিন যদি পড়িস লেখাটা, মাফ করে দিস) গালে হাত দিয়ে প‍্যারেডের দেয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে রইলাম। পরে সে বন্ধুই প্রস্তাব দিল আমরা প্রেম করতে পারি কি না? ভেবে দেখলাম এই বন্ধুটা এতোদিন ধরে সহ‍্য করে যাচ্ছে, আর এতো প্রতিভাবান হওয়া সত্বেও এখনো যখন আমার পাশেই বসে আছে তবে একবার চেষ্টা করেই দেখা যাক। আমরা ঠিক করলাম একেবারে ক্লাসিক স্টাইলে ডেটে যাব। হুমায়ুন আহমেদের নতুন ফিল্ম দেখতে যাব আলমাসে। পরদিন দুজনই সেজেগুজে গেলামও। কিন্তু অর্ধেক ফিল্ম দেখে এমন মাথা ধরলো, এতো ন‍্যাকামি... এতো ন‍্যাকামি... বাংলাদেশের মানুষ এগুলোরই ফ‍্যান !!! সব রাগ গিয়ে পড়লো বন্ধুটার ওপর, মনটা আবার নিষ্ঠুর হয়ে গেল। দাঁত মুখ শক্ত করে বললাম "আমি বাসায় যাব। এখন বাসায় যাব"। হকচকিয়ে বন্ধুটা আমাকে নিয়ে বেরিয়ে একটা রিক্সা নিল। কিছুদুর যাবার পর ওকে রিক্সা থেকে নেমে যেতে বাধ‍্য করলাম আর বল্লাম আমি একলা একলা বাসায় যেতে চাই। এই হল আমার প্রথম আচমকা ডেট। ওই বন্ধুটা তারপরও আমার সাথেই ছিল সবসময়। সহ‍্য করেছিল সবকিছু। আজও যদি এখানে থাকতো, পাশেই থাকতো জানি। কিছু অভিমান হয়তো ছিল, আছে, থাকবেও কোন এক কুচুটের কারনে, তাও। ও একদিন ছিল বলে আজও মনে হয় আমার কিছু মূল‍্য সত‍্যি সত‍্যি আছে যে অবস্থাতেই থাকি না কেন। 


প্রথম যেদিন একক আবৃত্তি করেছিলাম একদম বড়দের মত শিল্পকলায় আমার এক বন্ধু ও তার প্রেমিককেও নিমন্ত্রণ করেছিলাম। পাজিগুলো নিজেরা ডেট করতে চলে গেল কোথাও আর পাঠিয়ে দিল ওই প্রেমিকের এক বন্ধুকে। অন্ধকার অডিটোরিয়ামের কোনায় স্পট লাইটের আলোয় জামদানি পরে, খোঁপা বেঁধে আর বড় একটা টিপ কপালে দিয়ে যেকোন সদ‍্য ষোড়শী যদি রবিঠাকুরের 'সাধারন মেয়ে' পড়ে যায় তবে হয়তো খুব কম বাঙালি যুবকই আছে যাদের মনে প্রেম জাগবেনা। ওই সরল সিধা বেচারা সেই আলোআঁধারি আর রবিঠাকুরের ফাঁদে পড়ে ঠিক করলো এই সাধারন মেয়েটাকেই বিয়ে করবে। এমন পাগলামি করেছিল যে ওর মা ওর আর ওর বন্ধুদেরও কান ছিঁড়ে নিতে চেয়েছিল। তারপর সে নাকি অনেক মুখ গোমড়া করে ঘুরেছিল আর পরে হারিয়েও গিয়েছিল। সেই বেচারার বন্ধুরা নাকি সকাল সন্ধ‍্যা আমার বাড়ির নিচ দিয়ে যাবার সময় অহংকারি, ডাইনি, দেখবো কেমন বর পায় ইত‍্যাদি ইত‍্যাদি বলে শাপশাপান্ত করে করে যেত। শাড়ি পরার ভীষন পাগল ছিলাম আর যেন খুব তাড়াতাড়িই বড় হয়ে গিয়েছিলাম। যখন সতের বছর বয়স তখনও এক ফ্রান্স প্রবাসী শিল্পী ভুল করে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেছিল। আমার এই ব্লগে প্রথম ভিউটা প্রায় সবসময় ফ্রান্স থেকে হয়, তখন ওই লোকটার কথা মনে পড়ে যায়। আরেকজন ছিল সে এক দূর প্রবাস থেকে আধঘন্টা পরপর ফোন করতো বাড়িতে। এমন তার নিষ্ঠা ছিল বাবা আর বড় ভাইকে পর্যন্ত পটিয়ে ফেলেছিল! বাড়ি ফিরতে দেরি করলে কি বকাবকিটাই না করতো সে এক অভিভাবকের মতোই। বোনের বিয়ের পরপর ওর বরের গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম বেড়াতে। ওখানেই একদিন একটা দাওয়াতে যাচ্ছি তখন ওর দেওরের মোবাইলে ফোন করে বসলো ওই প্রবাসী ছেলেটা। না, ঘর থেকে বা আমার পরিচিত কারো কাছ থেকে পায়নি নম্বরটা। কি করে পেয়েছিল তা এখনও রহস‍্যে ঢাকা। আমি কেন যেন খুব ভয় পেতাম ছেলেটাকে। মনে হত এ সারাক্ষণ নজর রাখছে আর ঠিক আমাকে একদিন বিয়ে করে নিয়ে যাবেই। দুঃস্বপ্নও দেখতাম, দেখতাম একটা অন্ধকার ঘরে ও আমাকে আঁটকে রেখেছে। একবার নিউইয়ারে এতো সুন্দর সব গোলাপ পাঠিয়েছিল! ওগুলো ছিল গাঢ় রক্তের মতো লাল, মোটা মখমলের মতো পাপড়ি, এই এত্তো বড় বড়, হালকা নেশা ধরানো সুগন্ধের, ঠান্ডা দেশের রুপকথার গোলাপ। আমি যেন এক মুহূর্তে ভেবেছিলাম জীবনটা একটা রুপকথার গল্পই। আমি ভাবলাম যদি এই যুবকটাই হয় সেই একমাত্র একজন, তবে এই গোলাপগুলো আজীবন তরতাজা থাকবে। কিন্তু না, কদিন পরই গোলাপগুলো সব মরে শুকিয়ে গেল আর আমার ভয়টাও আবার ফিরে এল।


এমনটা নয় যে আমার কোন ক্রাশ ছিলনা। হুম। কোন কিছুই কখনো লুকিয়ে করতে পারিনি জীবনে আজ পর্যন্ত। যদি একবার কারো ওপর ক্রাশ খেতাম তবে বন্ধুরা ভাবতো এ সত‍্যি সত‍্যি কোন এক হীরের টুকরো রাজপুত্তুর আর ওরাও ক্রাশ খেতো। আর ওই ছেলেটার ওপর কয়েকজন মিলে একসাথে হামলে পড়ে এমন কাগাবগা পরিস্থিতি পাকাতো যে ঝোলে অম্বলে মিশে ওই বেচারা একদম ত্রাহিত্রাহি করতে করতে একেবারে আকাশে উঠে যেত, মাটিতে আর পা ই পড়তো না। এই কপালটা মাঝে মাঝে সত‍্যিই ইচ্ছে হতো পিটিয়ে পিটিয়ে ভেঙ্গেই ফেলি।


উচ্চ মাধ‍্যমিকের পর একে একে সব বন্ধুরা কেউ ছাড়লো শহর আর কেউ ছাড়লো দেশ। আমি প্রায় একলা পড়ে রইলাম জীবনের একটা নতুন অধ‍্যায়ে ঢুকে পড়বার জন‍্য। ওই ছন্নছাড়া সময়ে একজন কবির সাথে দেখা হল। সে জানালো সে তার বাকি জীবনটা কাটাতে চায় আমার সাথে। আমার বয়স তখন আঠার। একবছর পুরো তিনশ পঁয়ষট্টি দিন প্রতিদিন আমাদের শহরের প্রতিটি ধুলিকণা, প্রতিটি গাছের পাতারা, সমুদ্রের প্রতিটি ঢেউ আর পাহাড়ের প্রতি বিন্দু নির্জনতা জানতো আমাদের দমকা প্রেমের কথা। বাসায় একটা ষড়যন্ত্র টের পেলাম, আমাকে নাকি ঢাকায় নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়ে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবে। তড়িঘড়ি আমরা বিয়ে করে নিলাম তাই। না পালিয়ে নয়, বাবাকে বুঝিয়ে পারিবারিকভাবেই।

চলবে...

https://soundcloud.app.goo.gl/hEhHL


No comments:

Post a Comment

English Translation of Bangla Folk Song: Fakir Lalon Shah; চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি; Forever I Nurtured a Mysterious Bird

 Forever I Nurtured a Mysterious Bird Forever I nurtured a mysterious bird, which never discloses its identity. For this grief, my eyes ...