আমার বাসায় গত ষোল বছর ধরে যত গৃহ সহকারিরা এসেছে কিংবা থেকেছে ওদের সাথে আমার যে খুব একটা সবসময় আলাপচারিতা হয়েছে কিংবা হয় এমনটা নয়। ওরা কাজকর্ম করে চলে যায়, আর যারা থাকে তাদের কাজ শেষে এই ঘরের মধ্যে পুরোই স্বাধীনতা থাকে যেন তারা তাদের অবকাশটুকু যতটুকু সম্ভব নিজের পছন্দ মতোই কাটাতে পারে। TV আছে, WiFi আছে, ওরা তা নিয়ে সময় পার করতে পারে বা চাইলে ঘুমিয়েও পড়তে পারে কিংবা যদি কোন স্বজন বা বন্ধুবান্ধব থাকে তাদের সাথে কিংবা একলাও বাইরে ঘুরতে যেতে পারে। তবে একবার একটা ঝামেলা হয়ে যাওয়াতে নিচের সিকিউরিটি গার্ডদের এই বেড়াতে যাওয়া নিয়ে একটু আপত্তি আছে আর তাছাড়া আমারও এখন একটু অস্বস্তিই হয়। একটা মেয়ে এসেছিল কবছর আগে, আমার চাইতে বয়সে কিছু ছোট, দেখতেও মন্দ না। আসবার পরই দেখা গেল তার জলবসন্ত। ডাক্তারের কাছে নিলাম, ওষুধপত্তর দিল তারপর পাঁচছয় দিন সে বিশ্রামেই ছিল আর শুশ্রূষাও পেয়েছিল। সুস্থ হয়ে উঠল মেয়েটা, কাজে যোগ দিল, দেখলাম কাজেকর্মে ভালই। মনে হলো সেও আমাকে পছন্দই করছে, বিশেষ করে আমি যখন লম্বা কাঁচের গ্লাসে সুদৃশ্য ফালুদা তৈরী করলাম আর ওকেও দিলাম। দু'তিন দিন গেল ও সুস্থ হবার পর, তারপর এক বিকেলে ও বললো এক বোনের সাথে দেখা করতে যাবে। যাবার সময় যখন দরজাটা বন্ধ করতে গেলাম মনে হয়েছিল ও যেন অন্য কারো কাছে যাচ্ছে বা হয়তো ডেট করতে যাচ্ছে। ও বেশ সেজেছিল আর চোখে মুখে একটা অন্য কিছুই ছিল। ভাবলাম, যাকগে, ওর ব্যক্তিগত জীবন তো একটা আছে, ওটা নিয়ে আমি কেন ভাবতে যাব? কিন্তু সমস্যা হল, মেয়েটা আর ফিরলো না। ফোনও সুইচড অফ। আমি একলা মানুষ তখন ঘরে, ভাবলাম এতো ভাল বিপদ হলো। কোথায় গেছে, কোন বিপদে পড়েছে কি না কে জানে? ওকে যে এনেছে সেই খালাও কিছু বলতে পারলো না। সিকিউরিটির লোকেদের যে সর্দার সে কি না কি বুঝে বললো "গরীব মাইনসিরে বেশি দরদ দেখাইলে ফরে হ্যারার মাতা খারাপ হইয়া যায়। হেষে দিশ কুল না ফাইয়া এরম কান্ড করে। হ্যায় নিশ্চিত কোনো ফোলার খফফরে ফইড়া ভাগছে।" তা কি আর করব, কিছুতো আর করার নেই, যাই হোকনা কেন শুধু আশা রাখলাম যেন কোন বিপদ না হয় মেয়েটার। এই শহরটা একলা একটা মেয়ের জন্য মোটেও নিরাপদ নয়। আমি তখন চাকরি করতাম তাই সেদিকেই মন দিলাম আর সাথে নতুন লোক খুঁজতেও শুরু করলাম। সপ্তাহ খানেক পর একদিন মেয়েটা ফোন করলো। সে যেন নিচুস্বরে কথা বলছিল আর জানালো যে একটা ঝামেলা হয়ে যাওয়াতে ওকে গ্রামে চলে যেতে হয়েছে। কিন্তু সে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে আর কাজেও যোগ দেবে। আমি বল্লাম যে ভাই, তোমার কাজে যোগ দেবার প্রয়োজন নেই, তুমি বরং যত তাড়াতাড়ি পার এসে তোমার ব্যাগট্যাগ যা আছে নিয়ে যাও। এরপর আরো অনেক দিন কেটে গেল। নতুন লোক কাজে আসলো। ওর রেখে যাওয়া কালো রঙের বেশ বড় ব্যাগটা আমি ওপরের স্টোরেজে তুলে রাখলাম। বছর দুয়েকেরও বেশি কেটে গেল তারপর। স্টোরেজে আর জায়গা হচ্ছিল না তাই ওর ব্যাগটা শেষ পর্যন্ত প্রতিদিনকার ময়লা যারা নিতে আসে ওদের দিয়ে দিলাম। এর আরও হয়তো বছর খানেক পরে একদিন সন্ধ্যেবেলা কলিংবেল বাজলে "কে" জিজ্ঞিস করতেই ও পাশ থেকে একটা মেয়ে বললো যে সে হল সেই মেয়েটা যে এখানে কাজ করতো আর একটা ব্যাগ রেখে গিয়েছিল। আজ সে ব্যাগটা নিয়ে যেতে এসেছে। আমি দরজার হোল দিয়ে ভাল করে দেখতেই মনে হল আরে হ্যাঁ এ তো সেই মেয়েটাই! আমি দরজা খুললাম না বরং বললাম ওই ব্যাগটা আমি ফেলে দিয়েছি, সে কিভাবে এতো সাহস পেল এতো কান্ড করে এতোদিন পর ব্যাগটা ফেরত চাইতে এলো! আর সিকিউরিটিই বা কি করে ওকে ঢুকতে দিল। সে জানালো যে সে এই কমপ্লেক্সেই এগারো তলার একটা ফ্ল্যাটে কাজ নিয়েছে। আমি ওকে বল্লাম ও যেন আর কোনদিন আমাকে বিরক্ত করতে না আসে। মেয়েটা চলে গেল কিন্তু তারপরও আমার মেজাজ ঠিক হল না। আমি ইন্টারকমে সিকিউরিটি হেডকে বল্লাম, যে মেয়েটা একবার একটা বাসা থেকে পালিয়ে গিয়েছিল সে আবার কি করে এই কমপ্লেক্সেরই অন্য একটা ফ্ল্যাটে কাজ পেল? সিকিউরিটির লোকেরা ওই এগারো তলার ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখে নিশ্চিত হলো যে আসলেই এ হলো সেই পালিয়ে যাওয়া মেয়েটাই আর ওই ফ্ল্যাটের কর্ত্রীকে পুরো ঘটনাটা সবিস্তারে জানালো। পরে আমার কাছে এসেও দূঃখ প্রকাশ করলো আর বললো মেয়েটা নিশ্চই মুখটুখ ঢেকে এখানে ঢুকে পড়েছে, এরপর থেকে ওরা আরও সাবধান হবে।
মেয়েটার কাজটা চলে গিয়েছিল কি না আমি আর তার খবর রাখিনি। এতো সময় কোথায়? বরং এতোদিন পর এই বিষয়টা যে আবার উঠলো আর তাতে যে আমার কিছু সময় নষ্ট হল তা ভেবে বিরক্ত লেগেছিল। তবে পরে একদিন হয়তো আনমনে হঠাৎই ভেবেছিলাম, ও যে পালিয়ে গিয়েছিল, কার সাথে পালিয়েছিল বা আদৌ পালিয়েছিল কি না আর তারপর কি হয়েছিল? ফিরে আসবে বলে আবার কোথায় লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিল কিংবা এতো বছর পর ব্যাগটাই বা খুঁজতে এলো কেন? আর কি ই বা ছিল ওই ব্যাগটায়?
No comments:
Post a Comment