একটা বনের ধারে একটা ছোটখাট বেশ পুরোনো দোতলা একটা বাড়ি। দোতলার টানা বারান্দাটাই নেমে গেছে ডানদিকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি হয়ে বাড়ির পেছন দিকে। খোলা বারান্দা। কোন গ্রিল নেই। রেলিংটা কোমর অবধি মলিন সাদা রঙের, তার ওপরের দিকটায় সিমেন্টের ছাইরঙা গোলানো ধার। পুরোনো অনেক বাড়িতেই দেখা যায়, বিশেষ করে ছাদে। বারান্দাটার পর থেকেই বনটা শুরু। আর ক্রমশ ঘন গহীন হয়ে উঠেছে। এতো লতা গাছ উঠে গেছে চারদিকে। বহু প্রাচীন উঁচু উঁচু গাছগুলো তো ছেয়ে ফেলেছেই, সেই সাথে বাড়িটাকেও ঘিরে ফেলতে চাইছে। এতো সবুজ এত সবুজ আর যত দূরে চোখ যাচ্ছে আরো ঘন সবুজ হয়ে উঠছে। ওপরে আকাশ অনেক বেশি স্বচ্ছ আর নীল। পুরো জায়গাটা এত শান্ত শীতল আর ভেজা ভেজা, আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে যেতে চায়। বাতাস এতো নির্মল হতে পারে আগে আমার জানাই ছিল না। অনেক পাখিরা নিশ্চই আশেপাশেই আছে, সারাক্ষণই মিষ্টি কিছু চেনা অচেনা ডাক কানে আসছে। এই বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে বাবা বনটাকে দেখছিল। সেই গাঢ় ছাই রঙের ফরমাল প্যান্ট একটা সাদা রঙের সরু নীল স্ট্রাইপের হাফহাতা শার্ট ইন করে পরা, কালো বেল্টটাও ছিল। জুতো পরে ছিল কি না খেয়াল করিনি। তবে পেছন থেকেও দেখে বুঝেছিলাম ঠোঁটে সেই মৃদু হাসিটা লেগে ছিল। পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই চমকে উঠলাম একটু। বল্লাম "বাবা, তোমার চশমা কোথায়?" বাবা বললো "চশমা লাগেনা, আমি এখন সব দেখতে পাই।" তারপর আমরা দুজনই আবার বনটাকে দেখতে লাগলাম। বাবা চলে যাবার পর এ ছিল আমার প্রথম স্বপ্নে বাবাকে দেখা। এখনো যেন চোখের সামনেই রয়েছে দৃশ্যটা। এরপর আরো বেশ কবার দেখেছি, ওগুলোও স্পষ্ট মনে আছে। শেষবার যখন দেখলাম, গত মাসেই বোধ হয়, বাবা খুব রেগে ছিল আর চারদিকে তাকাতে তাকাতে বলেছিল "এখানে আর থাকতে হবে না। চলো আমার সাথে।"
বাবা তোমার মনে আছে, আমরা শপিং করে ফিরতাম তারপর এক এক করে তোমাকে সব দেখাতাম আর ভান করতাম যেন রুপার জন্য কিচ্ছু কেনা হয়নি বা কিনতে ভুলেই গেছি এমন। তুমি মন খারাপ করতে, রাগ করতে। কখনো কখনো তুমি প্রথমেই জিজ্ঞেস করতে "আগে বল আমার বউমার জন্য কি কিনছ?" জানো বাবা তোমার অমন কথা শুনে বা রাগ দেখে মজাই পেতাম। কোনদিন রুপাকে হিংসে করিনি। কিন্তু আজকাল রুপাকে খুব হিংসে হয় মাঝে মাঝে। মনে হয় তুমি রুপাকে নিয়ে গেলে তোমার কাছে, আমাকে নিয়ে গেলে না। জানো বাবা, যতো দুষ্টুমিই করি না কেন বা যত গোঁয়ার্তুমিই করি না কেন, আমি কিন্তু সত্যি সত্যি একটা লক্ষ্মী মেয়েই। তুমিতো জানোই। তুমিইতো সবচেয়ে বেশি জানতে বুঝতে আমাকে। হয়তো আমাদের কিছু বিশ্বাসের অমিল ছিল কিন্তু একদিন তুমিই তো অন্যদের বলেছিলে যে "হয়তো ও ই ঠিক, আমরা ভুল।" চলতি বিশ্বাসের চেয়ে সততার মূল্য তোমার কাছে অনেক বেশি ছিল।
বাবা, তুমি জানতো না, আমি তোমাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করি? অনেক দিন হয়ে গেল অপেক্ষায় আছি সেদিনের পর থেকে।
No comments:
Post a Comment