শান্তা এই রাতেই মরে গেল যখন ভর পূর্ণিমা আর সেই সাথে আবহাওয়াও চমৎকার। আকাশ এতো পরিষ্কার যেন সে কারনেই বাগানের কামিনী ফুলগুলো আরও বেশি সৌরভ ছড়াচ্ছে। মল্লিকার আগর বাতির গন্ধ আর এতোগুলো মেয়ের তীক্ষ্ম গলায় একসাথে এলোমেলো সুরা আর দোয়াদুরুদ পড়ার হট্টোগোল একদম ভালো লাগছে না। ওর মাথাটায় একটা ফাঁকা ফাঁকা অনুভুতি ভর করে আছে আর শরীরটাও হালকা লাগছে কেমন। অসহ্য লাগলেও উঠে যেতে পারছে না যদি পড়ে যায় এই ভয়ে। অনুসূয়া, ছোট করে সবাই ডাকে অনু, শান্তার আট বছরের মেয়েটাও ফ্রকের সাথে পাজামা আর মাথায় কোত্থেকে একটা ছোট ফুলেল হিজাব পরে কোরান পড়ছে। কতোটুকু কি পড়ছে কে জানে, দেখে মনে হচ্ছে ওর বসে থাকার শক্তিটুকু নেই আর শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। আর এতো কাঁদার পর চোখেও ভালো দেখতে পাবার কথা নয়। কিন্তু সবার কথা শুনে ওর বিশ্বাস হয়েছে যে ও যদি দোয়া করে, সুরা পড়ে ওর মা ভালো থাকবে, ওর মায়ের গুনা আল্লা মাফ করে দেবে। যদিও ও জানেনা ওর মা আসলে আদৌ কোনো গুনা করেছে কিনা। ওকে যে মাঝেমাঝে বকতো আর একদিন রাগ করে ওর একটা বারবি জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল, বাবার সাথে যে প্রায়ই রাগারাগি করতো আর কথা বলাও বন্ধ করে দিত, কখনো কখনো দাদুকে না বলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতো, মাঝেমধ্যে আনমনা হয়ে পড়তো, ঘর অগোছালো করে রাখতো, অনেক ইংরেজী ফিল্ম দেখতো কিংবা মাঝে মাঝে খারাপ রান্না করতো সেগুলোকেই গুনা বলে কিনা, এইসব ভাবার মতো অবস্থাও ওর আছে কি না কে জানে। মল্লিকার পুরো পরিবেশটা নারকীয় মনে হচ্ছিল অন্তত শান্তার ছোট্ট মেয়েটার জন্য তো বটেই। এই গরমে এতো মানুষের ভীড়ে আর এতো পোষাকের চাপে বেচারি পুরো ঘেমে নেয়ে উঠেছে। মল্লিকার এক মুহুর্তে মনে হয় কে তৈরী করেছে এই পৈশাচিক রীতিগুলো? আর মানুষ ই বা কিভাবে গ্রহন করেছে এসব নিষ্ঠুরতা? ওর সদ্য অনাথ বাচ্চা মেয়েটার জন্য বুকে খুব ব্যাথা হতে থাকে, আজকাল প্রায়ই বুক ব্যাথা করে সাথে শ্বাসকষ্টও হয় মল্লিকার। ওর শুধু মনে হয় এইসব লোকজনগুলোকে যদি বের করে দিতে পারতো এই ঘর থেকে, তারপর বাচ্চা মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকতো ঘর অন্ধকার করে আর একটা ঘুম পাড়ানি গান যদি গাইতে পারতো ওর কানে। বাচ্চাটার একটু ঘুমোনো দরকার। গত এতোগুলো মাস একটুও নিশ্চই নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেনি। আইসিইউতে শেষ যখন ওকে নেয়া হয়েছিল, ওর মা তখনো শ্বাস নিচ্ছিল হয়তো। ও শুধু মায়ের চুলে একটু আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়েছিল, মায়ের চোখের পাতা একটু নড়ে উঠেছিল কি না ঠিক খেয়াল করে উঠতে পারেনি। এর আগেও শান্তাকে বেশ ক'বার হাসপাতালে রাখতে হয়েছিল তখন ও বাসাতেই থাকতো। আজ সন্ধ্যায় হঠাৎ যখন ওর বাবা শান্ত গলায় বললো 'মা চলো তোমার আম্মুকে দেখবে' ও জানতো আর অপেক্ষায় থাকার কিছু নেই। হাসপাতালের রাসায়নিক গন্ধ, উজ্জ্বল সাদা আলো, চকচকে মেঝে, এতো ধাতব যন্ত্রপাতি, চেনা অচেনা লোকজন, বিবস মুখের ডাক্তার, মাথায় স্কার্ফ পরা ব্যস্ত নার্সরা, নীল পোষাকের কর্মচারিরা, দেয়ালের ফুলের আর সূর্যাস্তের ছবি, দেয়াল ঘেঁসে সুন্দর ফার্ণের বাগান, প্রচন্ড এসির ঠান্ডা, ধীরে চলা লিফ্ট, সব ওর একটা মিউট করে রাখা চলচ্চিত্রের মতো লাগছিল। ও শুধু নিজের শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দই যেন শুনতে পাচ্ছিল আর বাবার হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছিল তাড়াতাড়ি।
মল্লিকা মাথার ভেতরের বিরক্তি আর ক্ষোভটা আর যেন চেপে রাখতে পারছিল না। বুকের ব্যাথাটা বেড়েই চলেছে যেন ক্রমাগত। তাই আচমকাই উঠে পড়লো আর ঘরটা থেকে বেরিয়ে গেল। বসে থাকতে থাকতে পায়ে ঝিঝি ধরে গেছে তাও কোনো রকমে পা টেনে টেনে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। নিচের বসার ঘরটায় কয়েকজন হাফেজ হুজুর তারস্বরে কোরান পড়ে যাচ্ছে। লোকজনে ভর্তি নিচতলাটা, সবাই পুরুষ, বিভিন্ন বয়সের, প্রায় সবাই সাদা রঙের পাঞ্জাবি পরে আছে, কারো কারো মাথায় একরঙা সাদা কিংবা নকশাতোলা টুপি। আগর আর আতরের গন্ধের সাথে সাথে বিরিয়ানির গন্ধও ভেসে আসছে পাশের ডাইনিং স্পেস থেকে। কারো যদি খিদে টিদে পেয়ে যায়, তাই এই ব্যবস্থা করেছে কোন শুভাকাঙ্খী হয়তো। মল্লিকা ভেবে পেলো না এতো রাতে কি করে এতো আয়োজন করে ফেললো এরা। আর যাই হোক শোকের মাতন তো এ নয়, মানুষগোলো যেন প্রচণ্ড ভয়ে আছে আর সেই ভয়কে তুষ্ট করতেই এতো আয়োজন। শান্তার বরটাকেও দেখতে পেল, একটা সাদা পাঞ্জাবি পরে গাড়ি বারান্দায় কজন সমবয়সী লোকের সাথে একটা বেঞ্চিতে বসে আছে। বন্ধুবান্ধবই হয়তো এরা। দেখে খুব ক্লান্তই লাগছে শুধু, অনেকটা রোগা হয়ে গেছেন, কম ধকল তো যায়নি এ ক'মাস। সামনে একটা ঠান্ডা লাশের গাড়ি ওটাতে শান্তার দেহটা কাফনে আপাদমস্তক পেঁচিয়ে বেঁধে রাখা আছে। শেষ গোসল হয়ে গেছে এখন রক্তের সম্পর্কের নিকটাত্মীয় ছাড়া অন্য আর কোনো পুরুষ দেহটা দেখতে পারবে না, ছুঁতেতো পারবেই না। স্বামীও পারবে না, মরে যাবার পর নাকি স্বামী বেগানা পুরুষ হয়ে যায়। কিছু নতুন নতুন জিনিস শিখছে মল্লিকা এখানে আসার পর থেকে।
গাড়ি বারান্দা থেকে ডানদিকে এক চিলতে বাগানটার দিকে মোড় নেয় মল্লিকা। বাগানের মুখের বাতিটাই জ্বলছে খালি। ভেতরের বাতিগুলো সব নেভানো বা হয়তো নষ্টই। ভালোই হলো। হয়তো এ কারনেই এখানে লোকজন নেই বল্লেই চলে। মল্লিকা কামিনী গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। এই গাছটার নিচে শান্তার সাথে মল্লিকার খুব সুন্দর একটা ছবি আছে। ওইদিনই প্রথম আর এর আগে ওই একবারই এই বাড়িতে এসেছিল মল্লিকা। ওর মেয়ে লারার স্কুলে অনুও পড়ে, শান্তার সাথে ওখানেই আলাপ। সেদিন অনুর জন্মদিনে ওর কজন বন্ধুদের সাথে ওদের মায়েদেরও নিমন্ত্রণ ছিল। শান্তা বলেছিল সবাইকে শাড়ি পরে আসত আর পারলে একটু আগে আগে বিকেল করে যদি আসতে পারে। মল্লিকাই তাড়াতাড়ি বিকেল পাঁচটার মধ্যে এসেছিল। আর এসেতো এই আলিশান বাগান সহ দোতলা বাড়িটা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। শান্তার সাথে আলাপ করে কখনোই বুঝতে পারেনি ওরা এতো ধনী। মল্লিকার এতো অস্বস্তি হচ্ছিল, আগে জানলে আসতোই না। লারাকে মল্লিকার এক বান্ধুবী একটা পার্টি ফ্রক উপহার দিয়েছিল কিছুদিন আগে। একবারও পরেনি বলে ওটাই সুন্দর করে র্যাপ করে উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছিল। কি আর করবে এতো হিসেবের সংসার, একটা বাড়তি উপহার কেনার টাকা ওর আসলেই ছিল না। কিন্তু এতো সাবধানি হিসেবী জীবনের মধ্যেও মল্লিকা একমাত্র খুশি কারন হল লারা, মেয়েটা সত্যি বড় লক্ষ্মী হয়েছে। রাজ্যের দুষ্টুমি আর গোঁয়ারতুমীটা করে ঠিকই কিন্তু ওর আশা হয়তো একদিন সত্যি সত্যি মানুষ হবে। যখন ওকে জিজ্ঞেস করেছিল ওর নতুন উপহার পাওয়া জামাটা অনুকে দিয়ে দেবে কি না, প্রথমে যেন একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল লারা তারপর বেশ কিছুক্ষণ যেন গভীর কিছু চিন্তা করলো, তারপর হাসি মুখেই বললো "ঠিক আছে মা। খালি হাতে যাওয়া তো ঠিক নয়। তাই না?" মল্লিকার মনে হয়েছিল মেয়েটা বড় হয়ে যাচ্ছে বড্ডো তাড়াতাড়ি। তেমন কিছু আবদারও করে না। অভাবের সাথে মানিয়ে নিতে বাধ্য করে করে ও নিজেই যেন মেয়েটাকে জোর করে বড় বানিয়ে তুলছে। মল্লিকার একটু কান্না পাচ্ছিল, এমন একটা লাল টুকটুকে জামার খুব শখ ছিল লারার অনেকদিন। বাড়ির ফ্যান্সি শপিংগুলো ওর শ্বাশুড়ি দিলারাকে ছাড়া কেউ ভাবতেই পারে না। ওনার পছন্দের ওপর সবার অগাধ আস্থা। লারার জন্য কখনোই উনি লাল জামা কিনতে দেন না, বলেন, "অমন ময়লা গায়ের রঙে লাল জামা পরলে ওকে আরও কালো দেখাবে"। মল্লিকার খুব কষ্ট লাগে এমন ভাষা শুনে ওর এতো মিষ্টি মেয়েটাকে ওদের ময়লা মনে হয় আর ওর ঘন বাদামি রংটা ওদের কাছে কালো মনে হয়। দিলারা নিজের শারিরীক সৌন্দর্য নিয়ে সবসময় একটা অসুস্থ ঘোরের মধ্যে থাকেন বলে মল্লিকার ধারনা। একসময়কার ডাকসাইটে সুন্দরী দিলারা হয়তো ক্রমআগ্রাসী বার্ধক্যকে মেনে নিতে একদমই পারছেন না তাই সারাক্ষণই প্রচন্ড মেজাজ খারাপ করে থাকেন আর যখন তখন নিজের সৌন্দর্য এবং প্রবল বিশ্বাসের নীল রক্তের অহংকার জাহির করতে থাকেন। ছোট্ট লারাটাকেও তাঁর দম্ভের আঁচড় কামড় থেকে বাঁচাতে প্রতিদিন হিমশিম খেতে হয়। প্রতিদিন অন্তত একবার দিলারা মল্লিকাকে একটা কালো কন্যা সন্তান জন্ম দেবার জন্য খোঁটা দিয়ে যান। মল্লিকার যখন বিয়ে হয়েছিল দিলারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করে নিয়েছিলেন ওর উজ্জ্বল ফর্সা গায়ের রং, নিখুত চোখ মুখের অনুপাত, গড়ের চেয়ে বেশি উচ্চতায় আকর্ষনীয় শারিরীক গঠন, ঘন মেঘের মত কোঁকড়ানো চুল, সুন্দর কন্ঠস্বর ও বাচন এবং চলনসই শিক্ষাগত যোগ্যতা, মল্লিকার এবং সেই সাথে ওর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও। এতো সাবধানতার পরও যখন লারা জন্মালো মল্লিকার বর তারেকের চেহারা ও গায়ের রঙ নিয়ে নিজের অজান্তেই দিলারার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো ওদের মা-মেয়ের ওপরেই। প্রয়োজনের বাইরে লারাকে একটা খেলনাও কখনো মল্লিকা কিনে দেয়নি কিংবা কিনে দিতে পারেনি কোনদিন, ওদের ভাষায় বিলাসিতা বলতে শুধুমাত্র নিজে একা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সবার অমতের বিরুদ্ধে গিয়ে মেয়েটাকে শহরের সবচেয়ে নামকরা বেসরকারি বাংলামাধ্যম স্কুলে ভর্তি করিয়েছে। বাসায় লারাকে এখনও ও নিজেই পড়ায় তবু অন্য স্কুলের তুলনায় এখানে খরচটা একটু বেশি, সে কারনেই মল্লিকা নিজের এবং লারারও প্রায় সমস্ত শখ আহ্লাদ একরকম বিসর্জন দিয়েছে। এমন কি লারা একটু বড় হবার পর থেকে যেহেতু স্কুল তেমন একটা দূরে নয় তাই স্কুলে আসা যাওয়াটা পর্যন্ত ওরা পায়ে হেঁটেই করে।তারপরও দিলারার মনে হয় সে তার মেয়েকে নিয়ে বড় বেশি ন্যাকামি করে আর এতো লাই দিতে থাকলে ভবিষ্যতে ওকে সামলানো দুষ্কর হয়ে পড়বে।
আজ যখন সন্ধ্যায় অনুদের বাসায় ফোন করেছিল রাত প্রায় সাড়ে আটটা নাগাদ, শান্তার শ্বশুরই জানিয়েছিল যে সকালে শান্তাকে আবার হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ডাক্তাররা ওকে ক্লিনিকেলি মৃত ঘোষণা করে দিয়েছে। মল্লিকা হাসপাতালে ছুটে গেছে বাড়ির সবার আপত্তি সত্ত্বেও, সবাই বলছিল গিয়ে কি হবে, ভীড় বাড়িয়ে কি লাভ, অনেক রাতও হয়ে গেছে, সে তো আর খুব কাছের কেউ নয়, অতো বড়লোক লোকজন আগ বাড়িয়ে এতো দরদ দেখালে লোকে কি বলবে, কে যাবে সাথে বা পরে ফিরবে কি করে ইত্যাদি ইত্যাদি। আসল কথাটাই ওরা হয়তো এমন খারাপ খবরের সময়ে বলতে পারেনি যে এখন মল্লিকা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে ভাতটা কে রান্না করবে, টেবিলে রাতের খাবার, শ্বাশুড়ির ইনসুলিন, ওষুধ এগুলো কে সাজিয়ে দেবে কিংবা রাতের ধোয়াপালাগুলোই বা কে করবে? মল্লিকার কানে তেমন কিছুই ঢুকছিল না কিন্তু তারপরও যেন একটু কৃতজ্ঞ বোধ করছিল। আর ওর শুধু মনে পড়ছিল শান্তার ভীষণ বিষাদে ভরা বড় বড় চোখ দুটো, এতো অর্থনৈতিক বিভেদ, যোগাযোগহীনতা কিংবা সামাজিক দূরত্বের পরও যে চোখদুটো বলতো যে ওরা দুজন একই রকম, বড় বেশি একই রকম।
কামিনী গাছটার নিচে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এইসবই ভেবে যাচ্ছিল মল্লিকা। হঠাৎ মনে হলো লোকজন ওকে খেয়াল করছে তাই গাড়ি বারান্দার দিকে এগোতেই দেখলো তারেক দাঁড়িয়ে আছে লাশের গাড়িটার কাছে। ওকে দেখতে পেতেই হড়বড় করে বলতে লাগলো, "এসবের মানে কি মলি? রাত দুইটা বাজে। কতক্ষণ এসেছি এখানে। এরাতো কেউ তোমার নামও জানেনা আর চিনতেও পারছে না। বলেছিলাম আগেই এইসব বড়লোকদের ব্যাপার। তাও এলে যখন এতোক্ষণ কি? আর কোনো লাভ কি হলো? ফোনটা পর্যন্ত সাথে আনোনি। এতো ইরেসপনসিবল হলে কিভাবে কি? কোনো ভদ্রঘরের মেয়ে এতো রাতে বাসার বাইরে থাকে? আম্মা খুব ক্ষেপে গেছে। এতোক্ষণেও ঘুমিয়েছে কি না কে জানে। তুমি তো জানো আম্মা এসব আদিখ্যেতা, উড়নচন্ডিপণা একদম পছন্দ করে না। ক্ষেপে গিয়ে কি করবে আল্লাই জানে।" মল্লিকা নির্লিপ্ত গলায় বললো " হুম। এখন বাসায় যাবো।" তারেক যেন একটু হকচকিয়ে গেল ওর গলাটা শুনে। অনেক্ষন হাঁটার পর একটা রিক্সা পেল। রিক্সায় হঠাৎ নিরবতা ভেঙে তারেক বললো "ও হ্যাঁ! তোমাকে তো বলাই হয় নি। প্রজেক্ট বানাতে গিয়ে লারা এন্টিকাটারে অনেকখানি হাত কেটে ফেলেছে তুমি বেরিয়ে যাবার পর। কি রক্তারক্তি, কান্নাকাটি, মহাগন্ডগোলের মধ্যে পড়লাম, তুমি একটা বাসায় নাই। পরে রাতেও খেলো না কিছু।" মল্লিকা কিছু বললো না, শুধু ল্যাম্পপোস্টের বাতিগুলো দেখে যেতে লাগলো।
পরদিন সকালে লারার মুখটা দেখে মল্লিকার একটু বিরক্তই লাগতে লাগলো। এতো ছোটখাটো কারনে এতো মন খারাপ করলে পুরো জীবনটা কেমন করে কাটাবে। প্রজেক্টটা শেষ করতে পারেনি বলে ভীষণ মন খারাপ করে আছে আর মাঝে মাঝেই বাঁ হাতের ব্যান্ডেজ করা তর্জনীটা চোখের সামনে এনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। মল্লিকা জানে এইসব প্রজেক্ট বানাতে আর ছবি আঁকতেই লারার সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে। খুব আগ্রহ নিয়ে কাজগুলো নিজেই করে, মল্লিকা নিতান্তই দরকার হলে একটু সাহায্য করে দেয়। তারপরও এতো বিমর্ষ হয়ে পড়াটা ওর একটু বেশি বেশিই মনে হল। স্কুলে যেতে যেতে লারাকে বললো "দেখো লারা, একদিন প্রজেক্ট রেডি না হলে এতো মন খারাপ করার কিছু নেই। সবসময় সবকিছু একদম তোমার মন মতো হবে না। চেষ্টা করলেও না। আর হাতের দিকে তাকিয়ে থাকলে হাত তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে না।" লারা কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। ওর শুধু মনে হলো মা খুব রেগে আছে। মায়ের অনুর মায়ের জন্য মন খারাপ এটা ও জানতো, কিন্তু এতো রেগে কেন আছে তা বুঝতে পারছে না। লারা এটাও ভেবে পাচ্ছে না যে অনু এখন কি করছে। গতকাল তো মা একলাই গেল। আর ফেরার পর এই প্রসঙ্গে কোন কথাই হয়নি। আচ্ছা অনুর মা কি তাহলে আর কোথাও নেই? এটা ভাবতেই লারা ভীষণ চমকে উঠলো আর হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। ভীষন একটা ভয় যেন লারাকে চেপে ধরলো চারপাশ থেকে। মা আছে পাশেই তারপরও ওর খুব ভয় করতে লাগলো। দাদু গতকাল বলছিল অনুর মা ভাল না তাই এতো কষ্ট পেলো আর অনুও নাকি ত্যাঁদড় একটা মেয়ে, অনুর মা অনুকে কোন আদব কায়দাই নাকি শেখায়নি। অনুরা একদিনই এসেছিল ওদের বাসায় গত বছর। ইন্ডিয়া থেকে ফিরে কিছু ক্লাসের পড়া তুলে নিতে। দাদু খুব বিরক্ত হয়েছিল সেদিন। আর বলছিল ওরা এতো বড়লোক শুধু কটা চকলেটই আনলো ইন্ডিয়া থেকে! হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ায় মল্লিকার জীজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে লারা প্রশ্ন করলো "আচ্ছা মা, অনু খুব দুষ্ট তাই বলেই কি ওর মা ওকে ছেড়ে চলে গেছে?" মল্লিকা একটু ঘাবড়ে গেল লারার এমন প্রশ্ন শুনে। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললো "না লারা, অনুর মা অনুকে ছেড়ে কোথাও যায় নি আর কোনদিন যাবেও না।" মল্লিকা একটা রিক্সা ডেকে নিল। লারাটার হয়তো শরীরটা তেমন ভাল নেই আর তাছাড়া ওর নিজেরও ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।
লারাকে স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে মল্লিকা বাইরে শেডের নিচে বেঞ্চিগুলোর একটাতে বসলো। অন্য আরো কিছু মায়েরাও আছে আর থাকেনও সবসময়ই। সংসারের এতো ব্যস্ততার মধ্যে অনেকেই একটু দম ফেলে গল্পগুজবে মেতে ওঠেন কিছুক্ষণ। মল্লিকার তেমন সময় থাকেনা বেশির ভাগ সময়ই, সে লারাকে ছেড়েই হন্তদন্ত হয়ে বাসায় ছুটে যায়। কারন ঘরের আসবাবগুলো ঠিকসময়ে ঝাঁট দিয়ে পুরো ঘর গুছিয়ে না রাখতে পারলে পরে ঝামেলায় পড়তে হয়। বেলা এগারোটা নাগাদ খাদিজা বুয়া আসে আর হুড়মুড় করে দশ পনেরো মিনিটের মধ্যে ঘরটা কোনরকমে ঝাড়ু দিয়ে মুছে চলে যায়। সপ্তাহে একদিন ধোয় দুটো টয়লেট, সেদিন আর ঘর মোছে না। এই এতটুকু কাজ করেনা বলে মল্লিকাকে প্রতিনিয়ত বাঁকা মন্তব্য শুনতে হয় দিলারার কাছ থেকে। তা যাক, ওসব এখন ওর গা সওয়া হয়ে গেছে কিন্তু আবার ভাবে আসলেই কি তাই? আজ মল্লিকা বাসায় ফেরার তাড়া অনুভব করছে না একদম। চুপচাপ বসে থাকবে ঠিক করে অনেকক্ষণ। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারে শান্তার মৃত্যুর খবরটা এর মধ্যেই চাউর হয়ে গেছে। এই ছোট শহরটায় অমন সুন্দরী অমন বড়লোক বাড়ির কম বয়সী বউ মরে গেলে চাউর হবারই কথা। মল্লিকা একটু আনমনা হয়েই বসে থাকে কিন্তু চারদিকের জমে ওঠা আলাপচারিতাগুলো ওর কানে এসে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে যায়।
"আহারে... এখনও মেনে নিতে পারছিনা আপা। বাচ্চাটার কি হবে?"
"কি কষ্টটাই না পেল বেচারি। বরটাও নাকি পরে অনেক করেছে।"
"দেশের বাইরে নিল না, এতো টাকা ওদের। বুঝিনা বাবা।"
"আরে টাকা থাকলে হয়? মনও লাগে। বিয়ের পর থেকে একদিনও নাকি শান্তি দেয়নি শ্বশুরবাড়ির লোক। আমার বরের এক ভাগ্নির তো ওর এক মামাতো দেওরের সাথে বিয়ে হল সেদিন।"
"বাদ দিন ভাই, বাচ্চাটার কথা ভেবে খুব কষ্ট হচ্ছে। আপনারা কেউ গিয়েছিলেন? শুনেছি নটায় জানাজা ছিল, এতোক্ষণে হয়তো মাটি দিচ্ছে।"
"বাদ দেব কেন? অমন পরীর মতো হাসিখুশি মেয়েটা যে ওদের চোখের সামনে ক্ষয়ে যাচ্ছিল প্রতিদিন ওরা টেরও পেল না? শেষে নাকি শুধু হাড় আর চামড়া ছিল শরীরে।"
"আরে সেও কিছু কম ছিল না, শুনেছি বেশ চোপা করতো। আর ওই বিয়ের আগের একটা সম্পর্ক ছিল, ওটা নিয়ে তো সারাক্ষণ অশান্তি লেগেই থাকতো।"
"আরে রাখুন তো আপা, বিয়ের আগে কতো কিছুই তো থাকে কতজনের, তা এতো সমস্যা থাকলে ওরা ওই মেয়ে ঘরে তুললো কেন? বেচারি একটু ফেসবুকও ইউজ করতো না, ফোনও নাকি প্রায়ই বন্ধ থাকতো। আর বরকে ছাড়া কোথাও যেতোও না। একলা স্কুলে আসতো মেয়েকে নিতে শুধু, তাও গাড়ি নিয়ে। পুরোনো বন্ধুবান্ধবদের সাথে পর্যন্ত নাকি যোগাযোগ ছিল না।"
"লোভ আপা, লোভ। শুনেছি ওর বাপের বাড়িরও কিছু কম নেই। বিয়ের সময় অনেক কিছু পেয়েছিল। ভাইরা একমাত্র বোনকে সব প্রাপ্য একদম মিটিয়ে দিয়েছিল।"
"বরটা তো সারাদিন ইয়ার দোস্ত নিয়ে ক্লাবেই পড়ে থাকতো। শেষ কিছুদিন করেছে। তাতে কি? কিছুদিন পরেই ভুলে যাবে। দেখবেন হয়তো আরো বড় দাও মারবে কদিন পর। মাঝখান থেকে বাচ্চাটা..."
মল্লিকার মাথা ধরে যায় আবার ভীষণ। একটু টলতে টলতেই ও বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। মনে হয় এক্ষুনি পড়ে যাবে মাটিতে। গতকাল বিকেলের পর থেকে কিছুই মুখে তোলেনি। রোদের তেজটাও বেড়ে গেছে অনেক। ও হাত তুলে একটা রিক্সা ডাকে, গলা দিয়ে কিছুক্ষণ কোন স্বরই বেরোতে চায় না, তারপর অনেক কষ্টে বলতে পারে কোথায় যাবে।
লারার পরীক্ষা শেষ হয়েছে গতকাল। ওর ফুপুর সাথে তাই একটু বেড়াতে গেছে বাইরে। এমনিতে মল্লিকা ওকে একলা ছাড়ে না। তাও ভাবলো ও তো আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে, একটু একটু করে সবার সাথে মিশুক আলাদা করে। আর ওর নিজের জগৎটাও তৈরী করে নিক। সারাক্ষণ মায়ের পায়ে পায়ে ঘুরলে পরে পৃথিবীটা ওর খুব অচেনা মনে হতে পারে। সোমা ওর ননদ, ঢাকায় হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করছে। এখন কিছুদিন ক্লাস নেই তাই বাড়ি এলো। এখনই বেশ স্বাবলম্বি হয়ে উঠেছে, নিজের খরচ নিজেই চালাচ্ছে পার্টটাইমে টিউশনি আর এটা ওটা করে। মল্লিকার বেশ লাগে ওর উচ্ছল আর একরকম স্বাধীন জীবনযাপনের গল্প শুনে। তারেকও খুশি কারন বোনকে ওর তেমন কিছু দিতে হয়না। কিন্তু দিলারা খুব বিরক্ত পুরো ব্যাপারটা নিয়ে। ওর ঢাকায় চলে যাওয়া, হোস্টেলে থাকা পুরো বিষয়টার তিনি ঘোর বিরোধী। হোস্টেল কোন ভদ্র মেয়েদের জায়গা নয়। বিরুদ্ধাচরণ করেও তেমন কিছু আর করতে পারেন নি শেষ পর্যন্ত কারন স্বামী মারা যাবার পর তাঁর অবস্থান নিয়ে তিনি এখন খুব শংকিত থাকেন। ছেলের কথার ওপর আর তেমন একটা কথা বলেন না আজকাল। আর এই থম মেরে থাকা, বেশি বোঝা বউটাই তো আরো আগুনে ঘি ঢেলেছিল ননদটাকে শহরের বাইরে পাঠাতে। তবে এবার তিনি বদ্ধপরিকর, সোমার বিয়ে দিয়েই তবে ছাড়বেন। সোমা ঠিক মায়ের মতো না হলেও একেবারে ফ্যালনা নয়, একটু চেষ্টা করলে একটা বড়লোক বাড়িতে ঠিক সম্বন্ধ করতে পারবেন। আর তারেকের বড় চাচী বলছিল যে তার হাতে কয়েকটা বেশ ভাল পাত্র আছে। আল্লা চাইলে এবার দায়িত্বটা সেরে ফেলে নিশ্চিন্ত হয়ে যাবেন এমনটা ভাবতে ভাবতে দিলারা তার বিকেলের চাটাতে চুমুক দিলেন আর সাথে সাথেই থুথু করে চিৎকার করে উঠলেন "মলি এটা কি চা হয়েছে? কি এটা? না হয়েছে লিকার, না হয়েছে দুধ। এই অলক্ষ্মী বউ ঘরে আসার পর থেকে একদিনও শান্তি পেলাম না। সকাল বিকাল একটু আরাম করে চা খাব তারও জো নেই। এরকম হাভাতে ঘরের মেয়ে আনলে এমনই তো হবে...।" আজ মলির কি হল কে জানে মাথাটা প্রচণ্ড গরম হয়ে গেল। ও দিলারার সামনে থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে রান্নাঘরের সিঙ্কে সশব্দে রেখে আসলো। আর ফিরে এসে নিজের চায়ের কাপে নির্লিপ্তভাবে চুমুক দিতে থাকলো। মল্লিকার স্পর্ধা দেখে দিলারা একেবারে নির্বাক হয়ে গেলেন। তারেকও আশ্চর্য হয়ে গেল ওর এমন আচরণ দেখে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললো "এগুলো কি মলি? এগুলো কি ধরনের বেয়াদবি? তুমি এখনই আম্মার কাছে মাফ চাও। এখনই। তারপর ঠিকঠাক এক কাপ চা বানিয়ে আনো।" মল্লিকা যেন কিছু শুনতেই পায়নি এমন ভাব করে টেবিল গোছাতে শুরু করলো। তারেক এবার উঠে গিয়ে মল্লিকার পাশে গিয়ে প্রচণ্ড রেগে বলতে থাকে "মলি! এটা কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছো। এক্ষুনি মাফ চাও।"। মল্লিকা কোন উত্তর না দিয়ে রান্নাঘরের দিকে যায়। তারেক এবার আরো রেগে যেন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে থাকে। রান্নাঘরে গিয়ে চিৎকার করতে থাকে "এসব বেয়াদবি কিন্তু এখানে চলবেনা মলি। এসব করে কিন্তু তুমি এ বাড়িতে থাকতে পারবেনা।" মল্লিকা তারেকের দিকে ঘুরতেই তারেক আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না, রাগে তারেকের সারা শরীর কাঁপতে শুরু করলো, "মলি..." বলে চিৎকার করে উঠলো আর ওর ডানহাতটা উঠে গেল শূণ্যে। কিন্তু মল্লিকা তারেকের হাতটা ধরে নিল ওর গালে পড়বার আগে একটুও চোখের পলক না ফেলে। আর চোখে চোখ রেখেই এক ভৌতিক শীতল গলায় বলে উঠলো "সাবধান তারেক! সাবধান! আমি এতো সহজে হারবো না। কোথাও যাবোও না। মরবোও না। এই বাড়িতেই থাকবো। শুধু তোমরা জেনে নাও তোমাদের সাথে থাকতে আমার ঘেন্না করে।"

No comments:
Post a Comment