নগ্নতাকে যদি কোন Passion হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় তবে হয়তো সবচেয়ে খুশি হতো আমাদের একসময়ের টমবয় তুবা। কলেজে যখন তুবা ছিল অন্য সব ছেলে কিংবা মেয়েদের ধরাছোঁয়ার একদম বাইরে আর একই সাথে উত্তোরাধুনিক ও পৌরানিক সকল অবজ্ঞাময় ও ব্যাঙ্গাত্মক জীবনযাপন এবং শব্দভান্ডারের কেন্দ্রবিন্দুতে তখন কোন এক আহত যুবক তুবার ক্ষীনদেহ, সমতলপ্রায় বক্ষসৌষ্টব আর ছোটছোট করে কাটা চুলগুলোকে ইঙ্গিত করে বলেছিল "She is only a spoiled chic TomBoy. ওরে নিয়ে ভাবার কি আছে?" সবাই নামটা পছন্দ করেছিল আর কেন যেন আরো ভালবেসেছিল তুবাকে। ওরা সবাই মিলে আগলে রাখতো তুবার মুক্ত ও দ্রোহপূর্ণ অবস্থানটাকে, কেন তা হয়তো ওরা নিজেরাই জানতো না।
তুবার বাবাই ওর নাম রেখেছিল "তুবা", একটি কোরানিক নাম যার অর্থ হলো আনন্দ কিংবা উচ্ছাস। ধারনা করা হয় তুবা একটি গাছ যা শুধু স্বর্গেই জন্মে, যার ডালে বসে গান গায়, বাসা বাঁধে রহস্যময় ফিনিক্স পাখি। স্বর্গবাসীরা তুবার সৌরভে মাতোয়ারা হয়, তার ফুলের দর্শনে তাদের হৃদয়ের অহংকার দূর হয় আর আশির্বাদী ফলে তাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। আমাদের তুবা একটি উচ্ছসিত গাছের মতোই ছিল কিন্তু ভুল করে পৃথিবীতে জন্মেছিল বলে ও ভীষন ছুটতে পারতো, পাহাড়ে ও গাছে চড়তে পারতো, উদ্দাম নাচতে পারতো, যখন ইচ্ছে কাছে আসতে পারতো আবার দূরে দূরে সরে যেতে পারতো। শহরের সবচেয়ে বড় অভাগা ছিল যে বা যারা তুবার প্রেমে পড়েছিল সে সময়। ওরা মাথায় সুন্দরতম শব্দগুচ্ছ আর হাতে দূর্মূল্য উপহার নিয়ে যখনই আত্মপ্রকাশ করতো তখন তুবা, কি জানি বুঝে নাকি না বুঝে, তাদের শহরময় এমন দৌড় করাতো যে শরীরের সমস্ত ঘাম এবং ইচ্ছেশক্তি নিঃশেষ হবার পর ওরা শব্দগুচ্ছ এবং উপহার দুইই ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিত এবং মনে মনে প্রতীজ্ঞা করতো আজীবন দূর থেকে ওর ওপর নজর রেখে যাবে।
তুবার সাথে কারো সত্যিকারের শত্রুতা কোনোদিন ছিলনা। সে গলা ছেড়ে গাইতো সুখ, দুঃখ কিংবা জাগরণী গান, আওড়াতো অমোঘ কবিতার লাইন আর এমন সব বাক্য বলে উঠতো যে লোকেরা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রশ্নটির মুখোমুখি থমকে দাঁড়াতো। খুব সাধারন মানুষটিও ওর গান, কবিতা কিংবা বাক্যগুলোর সহজ স্বাভাবিক মানে করতো না কেন সে প্রশ্ন হয়তো তুবাই নিজেকে সবচেয়ে বেশি করেছে আজীবন। কলেজে সেদিন সবাই রীতিমতো আঁতকে উঠেছিল যেদিন তুবা ভর দুপুরে কলেজের মাঝখানে এক এলোমেলো ভীড়ের মধ্যে তেমন একটা না চেনাজানা মেয়েকে বললো "You have beautiful lips. Can I kiss you?" মেয়েটা কেন যে খুশি হয়ে উঠেছিল আর আন্তরিকতার সাথে বলেওছিল "Yes"। তারপর ওই অত্তো বৈচিত্রপূর্ণ ভীড়ের মধ্যেই ওরা দুজনই দুজনের ঠোঁটে একটা আবেগপূর্ণ ভেজাভেজা চুমু খেয়েছিল অল্প সময় তারপর দুজন দুজনকে "Thanks" বলে উল্টোদিকে হেঁটে চলে গিয়েছিল। ঘটনাটা এতোটাই আকস্মিক ও সততাপূর্ণ ছিল যে ওই তরুনদের মিছিলটা মোহমুগ্ধ হয়ে উঠেছিল কিছুক্ষণের জন্য হলেও। পরে ওরা এ নিয়ে কি আলোচনা করেছিল কিংবা বিচার সভা বসাবার কথাও ভেবেছিল কি না তার খবর তুবা কখনো রাখেনি কিংবা ভীড়ের সেই মেয়েটার খবরও আর কোনোদিন রাখেনি। ওর শুধু ঠোঁট দুটো মনে পড়ে আর মনে পড়ে জীবনের প্রথম সেই চুম্বনের কথা আজো।
না, আমাদের তুবা কোনোদিনই সমকামী ছিল না। সমকামী নারীদের সে চিরকাল ফিরিয়ে দিয়েছে একরকম সীমাবদ্ধতার অপরাধবোধ নিয়েই। চিরকাল অপেক্ষা করেছে তার সেই একমাত্র প্রিয়তম পুরুষের বিশ্বাসী আলিঙ্গন, কামনাগ্রস্ত উত্তাপ, মোহময় গন্ধ আর অপ্রতিরোধ্য মিলনের জন্য। কিন্তু ওর ভালবাসার পুরুষ ছিল হয়তো ওর কল্পনাতেই বন্দী, ছিল একান্তই নিজের জগতের এক অধরা ভুত, বাস্তবতায় যার অস্তিত্বই থাকবার নয়। চোখে বিষাদ, হৃদয়ে শুণ্যতা, মাথায় বিমূর্ত চেতনা আর ঘাড়ে এক অনিবৃত্ত ক্ষুধা নিয়ে তাই সে ভুতের সাথেই কথা বলে বলে ওর রাতদিন কাটতে থাকে। সময়ের এবং আদর্শের বিবর্তনে কখন যে তুবা হয়ে উঠেছিল সবার বিদ্বেষ প্রকাশের এবং চর্চাসুখের আধার তা সে জানতোই না। শুধু তাদের চোখে ঘৃণা পড়ে নিত প্রতিদিন আর একলা একলা হেঁটে যেত কোনো ব্যস্ত ফুটপাত, ওভার পাস কিংবা কোনো পাইকারি বাজারের ভীড়ের মধ্য দিয়েই হয়তো। খেটে খাওয়া সদাব্যস্ত ধেয়ে চলা শ্রমিকদের চোখের ক্রোধ, ধিক্কার কিংবা কোনো অপরাধ প্রবনতাকেও এড়িয়ে সে খুঁজতে শুরু করেছিল তার মানবজন্মের সত্যিকার মানে। আলোর নিচে অন্ধকার নয় সৌরজগতের গৌরব বেঁচে থাকে প্রতিটি সংগ্রামে এই বিশ্বাসের আঁকুতি নিয়ে ওদের মুখের দিকে চেয়ে থাকতো তুবা।
বলছিলাম নগ্নতা আর তুবার নগ্নতাপ্রেমের কথা। পরিবারের মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে গাঢ় রঙের চামড়া নিয়ে জন্মেছিল তুবা। সকলের সমস্ত উপেক্ষা, দুঃশ্চিন্তা এমন কি ঘৃণাকেও বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তুবা একটা দিনবদলের বাতাসে ওর পালকের মতো হালকা মন ও দেহটাকে ভাসিয়ে দিয়েছিল যেন। নিজের সাথে তার এতো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল যে আয়নার সামনে নিজের নগ্ন চেহারাটা দেখতে থাকতো প্রতিদিন আর দুহাত ওপরে তুলে এমনভাবে দাঁড়াতো যে ওকে সত্যিই স্বর্গের একটা দিনে দিনে বাড়তে থাকা গাছ বলেই মনে হতো। বাতাসে যখন ওর চুলগুলো উড়তো যেন মনে হতো ফিনিক্স পাখি ডানা মেলে গান গাইছে কোনো যার প্রতি স্বরে আছে পৃথিবী আর স্বর্গের চরম কোনো সত্য। ছোটবেলায় তুবার চোখদুটো নীল ছিল কিন্তু বড় হতে হতে তা পৌঁছে গিয়েছিল কালোর কাছাকাছি। তবে ওর টলটলে চোখে আকাশ ঠিক তার একাগ্রতার নীল ছায়া ফেলে গেছে চিরকাল, যেমন ছায়া ফেলে যায় পবিত্র নদী কিংবা সমুদ্রের বুকেও, সেই নীল চোখ শুধু প্রেমার্থীরাই দেখতে পায়। প্রেমে পড়লে মানুষ যে ভীষন হাঁদা হয়ে যায় তা তুবা খুব ভালোই জানতো। ও প্রায়শই মন দিয়ে ওদের নানান দূঃখের কথা শুনতো আর কি করে তা থেকে পরিত্রান পাওয়া যায় তা নিয়ে আলোচনা করতো। একজন সহমর্মী বিশ্লেষক এবং আন্তরিক মুশকিল আসানকারী হিসেবে ওর বেশ জনপ্রিয়তা ছিল পরিমন্ডলে। কিন্তু ওই প্রেমার্থীদের কেউ কখনো কখনো যদি ভুলেও ওকে স্পর্শ করতে চাইতো কিংবা কখনো আবেগে দেবী ভিনাসের সাথে তুলনা করে বসতো, ওর ইন্দ্রীয়গুলো সতর্ক হয়ে উঠতো আর মাথার ভেতর "Danger Danger" এলার্ম বাজাতে থাকতো। বহুবার 'বন্ধুদের ভাষায়' অতল খাদের প্রান্ত থেকে ফিরে এসেছিল তুবা। বন্ধুদের বোকা বোকা উৎকন্ঠা দেখে শুনে আকাশ বাতাস ফাটিয়ে হাসতে থাকতো তুবা তারপর আবার কি এক চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে পড়তো। বন্ধুরা বুঝতো না বিরক্ত হবে কি না আর ভাবতো কি এমন আছে তুবার ভেতর যার সন্ধানে থাকে এতো লোক? তুবাকে কেউ চটাতো না কারন ওর চোখে কি যেন এক গভীর বোধ ছিল যাতে সবার বুক কেঁপে উঠতো, ওরা যেন দেখতে পেত সেখানে কোন দূর্বাশার সাধনার আগুন আর জলের সহাবস্থান আর তারচেয়েও বড় কথা তুবার ছিল প্রবল ষড়যন্ত্রের দক্ষতা এবং হাত পায়ের ক্ষিপ্রতা।
আমাদের প্রিয় তুবা কখন যে শান্ত হয়ে গিয়েছিল আর অন্ধকার একটা ঘরে থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা আমরা কেউ জানতাম না। আমরা তখন নিজেদের ইঁদুর দৌড়ে তৈরী করতে ব্যস্ত আর নিজেদের যাবতীয় জটিল সমীকরণময় অংকগুলো সমাধান করতে প্রাণপাত করে যাচ্ছি। তুবা দিনরাত অন্ধকার দেয়াল বা ছাদের দিকে তাকিয়েই পার করে দিয়েছিল বছরের পর বছর। কিছু যে আসলে ভেবে যেতো এমনও নয়, ও যেন মাথার ভেতর একটা অন্ধকার গোলকধাঁধায় আঁটকে পড়ে গিয়েছিল। বেশ কিছু বছর এভাবেই একটা বিকল বিন্দুতে পড়ে থাকবার পর হঠাৎ একদিন কি মনে করে ময়লা জামা গায়েই বাইরে বেরিয়ে পড়লো আর হাঁটতে শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতে একেবারে শহরের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেল। সমূদ্র আর নদীর যেখানে মোহনা সেখানে লম্বা দেয়ালের ওপর একলা বসে রইলো একটা ভীনগ্রহের প্রাণীর মতো। রাতও নেমে গিয়েছিল ওভাবে বসে থাকতে থাকতে। রাত যখন বেশ আরো গভীর হলো তখন এক উৎসুক বখাটেকে জিজ্ঞেস করলো "I don't know how did I reach here. Can you take me home?"
তুবা জীবন বদলে নিয়েছিল। সে নতুন করে নগ্নতার প্রেমে পড়েছিল। নিজেকে আবার দেখতে শুরু করেছিল আয়নায়। সে আবারো নিজের জগতে মশগুল হয়ে পড়লো। মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো যত অশুচিতার বিশ্বাস। প্রেমার্থীদের সে ছুঁয়ে দেখতে দিল তার কোমল ত্বক আর শুষে নিতে দিল তার যৌবন সুধা। প্রেমার্থীরা জানালো তুবা সত্যিই একটা রহস্যময়ী সবুজ গাছ। ওদের কথা কতোটা সত্যি তা কেউ আমরা জানিনা কিন্তু ওই প্রেমার্থীদের মনোবাঞ্ছা কিভাবে যেন পূরন হয়েছিল। আঘাতপ্রাপ্ত পেয়েছিল শান্তি, অস্পৃশ্য পেয়েছিল মর্যাদা, উচ্চাকাঙ্খী পেয়েছিল আত্মবিশ্বাস, শিল্পী পেয়েছিল কল্পনা, দুষ্কৃতী পেয়েছিল নীলনকশা, হতাশাগ্রস্ত পেয়েছিল নবজীবন।
(ক্রমশ...)
No comments:
Post a Comment