রাস্তাটা চলে গিয়েছিল কত যে দূরে বাচ্চাগুলোর কেউই জানতোনা। শুধু জানতো ওই রেললাইনগুলো যতদূর পর্যন্ত গেছে রাস্তাটাও গেছে সাথে সাথে। ওরা সবাই পানসিগারেট আর টকমিষ্টি চকলেটের দোকানটার সামনে থেকে "রেডি ওয়ান টু থ্রি গো" বলেই দৌড় শুরু করতো ওয়াচটাওয়ারটা পর্যন্ত আর দেখতো কে কার আগে যেতে পারে। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতেই ওয়াচ টাওয়ারের একদম মাথায় উঠে যেতো আর চারদিকে উৎসুক হয়ে গলা উঁচিয়ে দেখতো বেশ অনেক্ষন যদিও একদিনের চেয়ে অন্য দিনের দৃশ্যে কোনো বলার মতো পার্থক্যই থাকতো না। সেইতো সারি সারি রেললাইনগুলো দৃষ্টির এমাথা থেকে ওমাথায় নানান রঙের গাড়ি চলা ব্যস্ত ওভার পাসটার নিচ দিয়ে চলে গিয়েছিল। রেললাইনের ওপারে, যেখানে ওদের যাওয়া একেবারেই নিষেধ, ওদিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যেতো ঘন হয়ে গায়ের সাথে গা লাগানো ইটের আর টিনের ছোটবড় বাড়িঘরগুলো, কিছু পায়ে হাটা ধীর গতির লোকজন আর একটা সবুজ মসজিদও আলাদা করে চোখে পড়তো। অনেক চেষ্টা করেও ওরা বাজারটা খুঁজে পেতোনা, বড়রা যেখানে প্রতিদিন যেতো আর নিয়ে আসতো মাছ মাংস সবজি ডিম, বাকিতে মাসকাবারি, খাতা কলম রং পেন্সিল, কুড়মুড়ে খাস্তা চানাচুর বিস্কুট জিলিপি সব এমন কি মায়েদের যখন শরীর খারাপ থাকতো তখন সকাল বেলায় খবরের কাগজে মোড়া যে ডুবো তেলে ভাজা গরমগরম মুচমুচে পরোটা আর মিহিদানা পাওয়া যেতো, যার গন্ধে ওরা তাড়াতাড়ি শোয়া থেকে উঠে পড়তো, তাও নাকি ওই বাজারেই পাওয়া যেতো। মহররমে ওখানে মেলা বসলে ওরা কেউ কেউ গিয়েছিল বাবা মামা চাচা দাদু কিংবা বড় ভাইদের হাত ধরে কিন্তু গেলে কি হবে ওই অত্তো শতশত এলোমেলো চলা পায়েদের ভীড়ে ওরা কিছু ভাল করে দেখতেই যে পায়নি। তবে বাড়িতে ফিরে আঙুলি আর তিলের খাজা খেয়েছিল বেশ মজা করে আর প্লাস্টিকের বাহারি পুতুল গাড়ি হাড়িপাতিল বন্দুক ইয়োইয়ো আর বাবেলারগুলো দিয়ে খেলেছিল অনেকদিন ওগুলো একেবারেই ভেঙে না যাওয়া পর্যন্ত। এপারে ওয়াচ টাওয়ার ঘেঁষে অত্তো উঁচু দেয়ালটাও এমাথা থেকে ওমাথা রেললাইনের পাশে পাশে যেন তৈরী করা হয়েছিল ওদের যত দুরন্তপনাগুলোকে এপারের উঁচু উঁচু গাছ ও তিনতলা বাড়িগুলোর সারি আর তাদের মাঝে এই কোনোদিন শেষ না হওয়া রাস্তাটাতেই আঁটকে রাখতে। এখানে সব ছিল খেলার ছোট বড় মাঠ, অনেক শখের বাগান, অল্প কটা খুবই ছোট ছোট দোকান, বেলুন, আইসক্রিম আর বাদামওলা। ওয়াচ টাওয়ারটার ওপর ওরা বেশ কিছুক্ষণ কাটাতো যদি এরমধ্যে কোনো ট্রেনের জোর হুইসেলের শব্দ শোনা যেত, ওরা আরও উৎসুক হয়ে গলা বাড়িয়ে দিত শব্দ বরাবর একটু পরেই দূরের ঝাপসা জায়গাটার ভেতর থেকে ক্রমেই বাড়তে থাকা বিকট ধাতব শব্দ তুলে এক দারুন মজার তালে তালে বাঁশী বাজাতে বাজাতে প্রিয় এক রাস্তাফেরি বন্ধুর মতো ট্রেনটা এগিয়ে আসতো। ওরা সবাই আনন্দে লাফিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠতো আর ট্রেনটা আর শব্দটা পুরোপুরি মিলিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত হাত তুলে তালেতালে নাড়তো আর মুখে "টা টা টা টা" বলে যেত। তারপর শান্ত হয়ে সেদিনকার মতো ওরা ওয়াচ টাওয়ারটা থেকে নেমে আসতো আর রাস্তাটা ধরে হেলেদুলে হাঁটতে হাঁটতে হয়তো একটা রাস্তায় পড়ে থাকা শুড়কিকে অযথাই পা দিয়ে ঠুকতে ঠুকতে ওরা এগোতো। ততোক্ষণে সূর্যটাও পড়ি পড়ি করতো তাই ইচ্ছে না থাকলেও বাড়ি ফেরা ছাড়া ওদের আর উপায় থাকতো না।
ওই রাস্তাটা এতো ছায়াঘেরা ছিল যে লোকে হেঁটেই পার হতো। খুব কম সময়েই একটা দুটা রিকশা বা সাইকেল দেখা যেত। হঠাৎ যদিবা একটা মটর গাড়ি আসতো বাচ্চাগুলোর বিষ্ময়ের শেষ থাকতো না যে কাদের অমন গাড়িওলা আত্মীয় বন্ধু আছে ভেবে। ওখানকার ফ্ল্যাটগুলো দু'কামরার খুপরি মতো ছিল আর বাইরে অনেক খেলার জায়গা ছিল। লম্বা দেয়ালটার যেখানে ঘুরতে পারে এমন একটা লোহার ফটক ছিল যেটা দিয়ে একবারে মাত্র একজন লোকই কেবল এদিকে বা ওদিকে আসা যাওয়া করতে পারতো, ওই ফটকটা দিয়েই বড়রা সবাই বের হতো আর রেললাইনগুলোর ওপারে বাজারে যেতো। তার পাশেই ছিল পান সিগারেটের দোকানটা। দু'তিনটা রিকসাও দাঁড়িয়ে থাকতো। রিক্সাওলাগুলো ঘাম মুছে হাত পা ঝাড়া দিত তারপর খয়ের আর জর্দা দেওয়া পান মুখে নিয়ে বিড়িতে নবাবী সুখটান দিত। কলোনির উঠতি বয়সের মামাগুলো সবসময় থাকতোই ওখানে। থাকেথাকে রাখা ইঁটের ওপর ওরা বসে থাকতো। শীষ দিত আর কখনো হাতে তুড়ি বাজিয়ে গাইতো "ক্যায়সা লাগতা হ্যায়। আচ্ছা লাগতা হ্যায়। প্যায়ার কা সাপনা। সাচ্চা লাগতা হ্যায়।" আবার কখন আবেগে দুহাত মেলে গেয়ে উঠতো "জানে জিগার জানে মান | মুঝকো হ্যায় তেরা কসম"। ওরা বেশ ভাল ছিল আর কাজেরও ছিল। কলোনির সবার খবর রাখতো আর ফুটফরমাসও খাটতো। মাঝেমাঝে বাচ্চাগুলোকে চকলেট আর সুইটবলসও খাওয়াতো। পড়াশুনোয় ওদের তেমন মন ছিলনা বলে কলোনির আঙ্কেল আর দাদুগুলো যতোই ওদের গালমন্দ করুক না কেন দরকারে ওদেরই ডাকতো আর ভালও না বেসে থাকতে পারতো না।
দোকানের মোটা কালো লোকটা ভীষন ব্যস্ত থাকলে কি হবে সবসময় তীক্ষ্ম নজর রাখতো যেনো কোনো একটা বাচ্চাও ফটক গলে ওপারে যেতে না পারে। কিন্তু তারপরও ওরা কেউ না কেউ হঠাৎ হঠাৎ সুযোগ বুঝে ঠিক বেরিয়ে পড়তো। ওপারে যাবার জন্য নয় রেললাইনের এধারেই যে টুকরো টুকরো রঙিন কাপড়ের পাহাড় বানিয়ে রাখা থাকতো তার ওপর দাপাদাপি করবার জন্য, রেললাইনের ওপর ভারসাম্য রেখে হাঁটবার জন্য, আর ফেরার সময় কিছু নুড়ি পাথর আর রঙিন কাপড়ের টুকরো সাথে করে নিয়ে আসবার জন্য। ওগুলো ওদের অনেক কাজে লাগতো ওই টুকরো কাপড়গুলো দিয়ে সহজেই হয়ে যেতো হাতে বানানো ছোট্ট ছোট্ট কাপড়ের পুতুলদের নতুন নতুন জামা বিছানা বালিশ আর ওদের বাক্সঘরের পর্দাও। পাথরগুলো ওরা জমিয়েও রাখতো কেন যেন আর ঢিল ছুঁড়ে আম কুল পেয়ারা আর বেলুম্বি তো পাড়তোই।
দোকানটা বরাবর সামনে যে বাড়িটা ছিল সেটাই ছিল ওখানে বড় মুখ করে বলবার মতো একমাত্র বাড়ি। চারধারে উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা, সেই দেয়ালের ওপর আবার ছুঁচোলো ভাঙা কাচের টুকরো গাঁথা ছিল। ওই বাড়িটার ছিল তিনকোনা টুপির মতো গাঢ় লাল রঙের টিনের ছাদ আর পূবে পশ্চিমে বাগান, বাইরে থেকে দেখা যেতো উঁচু দেয়ালটা ছাড়িয়ে সিঁদুরে আম, জাম, কাঁঠাল, কুল, নারকেল আর ডাঁসাডাঁসা পেয়ারার গাছগুলোকে। ভেতরে আরও কত কি গাছ ছিল কে জানে? ওরা মাঝে মাঝে লোভ সামলাতে না পেরে যখন ঢিল ছুড়তো দেয়াল ছাড়িয়ে রাস্তার দিকে ঝুলে পড়া আমগাছটায় তখন ওবাড়ির ঢ্যাঙা বুড়িটা চেঁচিয়ে উঠতো "ক্যাডা ক্যাডা" বলে। সুন্দর দেখতে বউটা শুধু মাঝে মাঝে গেইটে এসে দাঁড়াতো, ওদের আমটা, জামটা, পেয়ারাটা দিত, কখনো বা দিত বিদেশী চকলেট। মাঝেমাঝে আবার মামাগুলোর কাউকে হাত নেড়ে ডাকতো আর এটা ওটা এনে দিতে বলতো দোকান থেকে। বেদেরা যখন আসতো আর চেঁচাতো "চুড়ি লাগবিগো, চুড়ি লাগবিগো" বলে, সুন্দর বউটা ছিল ওদের বাঁধা ক্রেতা। বেদে মেয়েগুলো ওর সরু রোমহীন হাতদুটোয় লাল নীল সবুজ হলুদ রেশমী চুড়িগুলো যত্নে পরিয়ে দিত আর গালে হাত দিয়ে দুষ্টু হেসে বলতো "তুমার খসমের মাথা একদোম ঘুইরে যাবে গো দিদি দেইখো" ওরা আরো বেচতো চুলের ক্লিপ, খোঁপার কাঁটা, গলার মালা আরো কতো কি। ওদের ঝাঁপিতে সাপ থাকতো আর বীণ থাকতো উজ্জল রঙের গামছা দিয়ে মোড়া। ওরা মাথার চুড়োয় খোঁপা বেঁধে ফুলের মালা জড়াতো, হাঁটুর একটু নিচ পর্যন্ত শাড়ি পরতো আর কোমর দুলিয়ে অন্যরকম ছন্দে হাটতো। ওদের গায়ে থাকতো আঁশটে গন্ধ। যখন তখন যেমন হেসে গড়িয়ে পড়তো এ ওর গায়ে তেমনি চট করে রেগেও যেত। বাচ্চাগুলো ওদের জিনিস পত্তর ধরতে চাইলে কখনো বা ধমকে উঠে বলতো "ওই বাইচ্চা! একদোম কাইচ্চা বানাই দিবো!" ওরা নাকি অনেক যাদু টোনা জানতো। একদিন চুড়ি বেচে পরদিন ওরা মোড়ের মাথায় সাপ খেলা দেখাতো। বেদে ছেলেরাও আসতো তখন, ওরা মরা মানুষ জীবিত করে দেখাতো, আরো দেখাতো হাত সাফাইয়ের নানান খেলা, সেই সাথে বিক্রি করতো জড়িবুটি।
বউটার ছোট্ট একটা বাচ্চা ছিল। এতো ছোট যে বসতেও হয়তো শেখেনি। মাঝেমধ্যে বাবার কোলে চড়ে রাস্তায় হাওয়া খেতে বেরুতো। ওর বাবাটা এতো চিকন ছিল, মুখটা ছিল আরও চিকন, চোখের নিচে কালি, এতো লম্বা ছিল যে কুঁজো হয়ে হাঁটতো। হঠাৎ হঠাৎ কোনোদিন জোরে জোরে গেইটটা ধাক্কাতো, না খুললে ক্লান্ত হয়ে বাইরেই বসে পড়তো কাঁপতে কাঁপতে আর নিজেই নিজের ঘাওলা হাতে ইনজেকশন দিত। বাড়িতে ওদের গল্প করলে বাবা মা বলতো যে আর কোনোদিন ওই বাড়ির ধারে কাছে গেলে পিটিয়ে লাল করে দেবে। ওরা বুঝতেই পারতো না ওদের দোষটা কোথায়, যেমন বুঝতোনা কেনো মার খেতো ওই পিচ্ছিল বেলুনগুলো দিয়ে খেললে। যাই হোক, বেশিরভাগ সময় ওরা বাড়ির কাছাকাছিই খেলতো। খেলতো পাতাপাতা, রঙরঙ, কুমিরডাঙা, কানামাছি আরো কতো কি। একটু বড়রাও মাঝে মাঝে ওদের বউচি বা সাতচাড়া খেলায় নিত, তখন ওরা থাকতো দুধভাত।
ওরা দুধেভাতেই ছিল। দুধওলা আসতো, আসতো ভাঙা ডিমওলা, মাছওলা, তরকারিওলা, সুগন্ধি চালওলা আরও কতজন। বাবারা সব অফিস যেতো সকাল সকাল তারপর ফেরিওলারা সব রাস্তাটা ধরে হাঁকতে হাঁকতে যেতো। মায়েরা দরদাম করে, ইনিয়ে বিনিয়ে, কিংবা কখনো ঝগড়া করেই কিনে নিত যার যা চাই। শীতের দিনে নতুন ভাজা মুড়ির মোয়া নিয়ে ঘুরতো একটা তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে যাওয়া সাদা শাড়ি পরা মাসি। এই এত্তো বড়ো বড়ো মোয়া দুহাত দিয়ে ধরতে হতো আর কামড়াতে বেশ বেগ পেতে হতো। মাসির কাছে আরও থাকতো নারকেল নাড়ু, গজা, প্যাড়া আর ঝোলা গুড়। স্কুল থেকে ফেরার পর খেয়ে দেয়ে খেলতে খেলতে কিংবা ছবির বই দেখতে দেখতে যেই না ঘুমঘুম পেতো ওমনি ডাক পাড়তো ছিট কাপড়, তাঁত আর লেসফিতেওলারা। মায়েরা নিজেদের জন্য নিত তাঁত আর কাটপিস ছিট কাপড় কিনতো বাচ্চাদের জামা আর ব্লাউজ বানাবার জন্য। লেসফিতেওলার কাছে পাওয়া যেতো কানের দুল, সোনার মতো হার, মাথার ব্যান্ড, বুড়িদের টারসেল, নেইলপলিশ, লিপস্টিক, রঙিন চশমা আরও এতো কিছু যেন দেখতে দেখতে শেষ হতো না।
বিকেলে সূর্যটা শান্ত হলে ওরা খেলতে যেত নিয়ম করে চুল আঁচড়ে, জুতো পরে। কিন্তু সমস্যা হতো যখন আসতো আল্লাসুদা পাগল। কোত্থেকে যে সে আসতো হঠাৎ হঠাৎ! ইয়া বড় বড় চোখ আর কুচকুচে কালো চেহারায় কি ভীষন রেগে রেগে চেঁচাতো "আল্লাসুদা দুইটা বাত দ্যান"। ভয় পেয়ে ওরা লুকিয়ে পড়লে কি হবে বড় ভাইয়াগুলো ক্ষেপাতো ওকে "আল্লাসুদা, আ আ আল্লাসুদা" বলে বলে। ভীষন ক্ষেপে গিয়ে এইবড় ইটের টুকরো নিয়ে তাড়া করতো আল্লাসুদা পাগল। কেউ যদি ওকে খেতে কখনো দিত তবে সে দুইহাতে চারিদিকে ছড়িয়ে এতো বিচ্ছিরি করে খেতো আর শুধু ভাতই খেতো, তরকারি ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিত আর মুখে ভাত নিয়েই মাঝেমাঝে বলে উঠতো "আল্লাসুদা"। ওর চাইতে বার্মিজ বুড়িটা অনেক ভাল ছিল। প্রতি রমজানে অনেক দুকাপড় পরা বার্মিজরা দল বেঁধে আসতো আর ফটকটার উল্টো দিকে সোজা চলে যাওয়া একটু চওড়া রাস্তাটার ধার ধরে ওরা পলিথিন দিয়ে ঘর টাঙিয়ে ঘাঁটি গাঁড়তো। তারপর আবার ঈদের আগে আগে চলেও যেত। কিন্তু ওই বুড়িটা কোথাও আর যেতো না। ওর মাথাটি ছিল পুরো কাকের বাসা, রাতদিন কোথাও একটা বসে থাকতো আর বিড়ি টানতো, একটা কথাও বলতো না, কেউ খেতে দিলে চুপচাপ লক্ষী হয়ে খেয়ে নিত।
তা এক রমজানে ভরদুপুরে বিকট শব্দে বোমা ফাটলো রাস্তাটায়। একটা মামার হাত এতো পুড়ে গেল যে, শবেবরাতে রকেটবাজি তারাবাজিতে পোড়ার চাইতে অনেক অনেক বেশি, ওকে হাসপাতালে নিতে হল। তারপর বিকেল অব্দি দুদিক থেকে মামাগলো লাঠি আর হকিস্টিক হাতে তেড়ে এলো আর খুব মারামারি করলো। পুরো সন্ধ্যেটা ওরা মিছিল করে গেল "স্বৈরাচার নিপাত যাক", "জুতা মারো তালে তালে" এইসব বলে বলে। বাচ্চাগুলো না শুধু বড়রাও বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিল। রাস্তাটা পুরোপুরি চলে গেল উটকো লোক, পুলিশ, আর সবচেয়ে বেশি মামাগুলোর দখলে। বাবারা নিচুস্বরে কথা বলতো নিজেদের মধ্যে আবার বলতো "আস্তে বলেন ভাই, বোঝেনই তো, সরকারি চাকরি, চলে গেলে পথে বসতে হবে"। তারপর একদিন বাবারাও কেউ কেউ মিছিল করতে যেতে লাগলো। একদিন একটা পুলিশের গাড়ি ইমন মামাকে ধরতে এসে ওর জমজ ভাই সুমন মামাকে ধরে নিয়ে গেল। তার দুদিন পরে ইমন মামাকেও ওর এক বন্ধুর বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গেল। সেদিন রাতেই ওদের বাবা, যার সাদা সাদা চুল, সবসময় হালকা ছাই রঙের লম্বা পাঞ্জাবি আর সাদা ঢোলা পাজামা পরে থাকতো, ওই দাদুটাকে এম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল।
এর মধ্যে একদিন ইদও চলে এলো। সেদিন কেউ হকিস্টিক হাতে বেরুলো না। মিছিলও করলো না। সব ছেলেরা পাজামা পাঞ্জাবি পরে নামাজে গেলো। বাড়িতে নতুন জামা গায়ে দিয়ে, সেজেগুজে, সেমাই জর্দা খেয়ে বাচ্চারা পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো বড়দের আর বাড়ির সেলামি বুঝে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো কলোনির অন্য বাড়িগুলো বেড়াতে। খাবার দাবার আর সেলামি পেয়ে পেয়ে ওদের ছোট ছোট পেটগুলো আর পকেটগুলো একদম ভরে উঠলো দুপুর নাগাদ। ওরা তখন আইসক্রিমওলাটাকে খুুঁজছিল, রঙিন আইসক্রিম খেয়ে খেয়ে জিভগুলো সবুজ বা কমলা করতে করতে বাড়ি ফিরবে বলে। ঠিক তখনই ওরা দেখলো অনেকে ছুটে ছুটে পান সিগারেটের দোকানটার দিকে যাচ্ছে। ওরাও ছুটতে লাগলো সেদিকে। বড়রা চোখ লাল করে ওই ইদের দিনেও ওদের ধমকালো বাড়ি ফিরে যাবার জন্য। কারও যেন কোন মাথার ঠিক নেই। বারন না শুনে ওরা ছুটে গিয়ে যা দেখলো তা যেন ঠিক ওরা বুঝতে পারছিল না। কয়েকটা মামা আর সুন্দর বউটার বরসহ পাঁচ ছ'জন ওই মামাটাকে যে দুহাত মেলে খুব আবেগে "জানে জিগার জানে মান | মুঝকো হ্যায় তেরা কসম" গাইতো তাকে খুব মারছে হাতের কিরিচ, ছুরি আর নান চাকু দিয়ে। ওর সাদা পাঞ্জাবিটায় ছোপ ছোপ রক্ত। ও কিছুতেই পেরে উঠছিল না ওদের সাথে। অতো সুন্দর মামাটা আজ সকালেই তো ওদের প্রত্যেককে দোয়েলের ছবিওলা চকচকে নতুন দু'টাকার একটা করে নোট দিয়েছিল। ও চিৎকার করছিল "তোরা কি করতেসস? ভুল করতেসস ভাই তোরা।" কিন্তু একজন ওর আরও কাছে গিয়ে ছুরি দিয়ে ওর তলপেটে দুইবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পোচ দিয়ে ছেড়ে দিল আর পাঁচ ছ'জনই "পালা পালা, ভাগ ভাগ" বলে একসাথে পালালো। সবাই অবাক হয়ে দেখলো। মামাটা ওই দেয়াল ঘেরা বাড়িটার সামনে পেটে হাত চেপে দাঁড়িয়ে "শিরু... শিরু..." বলে চেঁচিয়ে রাস্তার ওপরেই পড়ে গেল। ওর কাটা পেট দিয়ে ছলকে ছলকে রক্ত বেরিয়ে আসছিল। সুন্দর বউটা ছুটে এলো আর চিৎকার করতে লাগলো "কেউ একটা এ্যাম্বুলেন্স ডাকেন" বলে। তারপর বাড়ির ভেতর থেকে বড় এক রোল তুলো এনে মামাটার পেটে চেপে ধরে বড় বড় চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মামাটার মুখের দিকে। যে বাচ্চাগুলো ওখানে রয়ে গিয়েছিল ওরাও তাকিয়ে ছিল এক দৃষ্টিতে। একটা ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে বাজিয়ে পার হচ্ছিল তখন কিন্তু ওরা একটুও শুনতে পাচ্ছিল না।
(ক্রমশ...)
https://youtu.be/DN5u2pxHh_Q
No comments:
Post a Comment