Thursday, December 9, 2021

পাখি আর বুড়ো

উড়তে শেখার পর দূর্বল পাখিটাকে কেউ তাড়া করলো আকাশে, কেউ ঢিল ছুড়লো, কেউ ঠুকরে গেল বারবার। কিন্তু একদিন কারো একটা তীর এসে চিরেই দিলো ওর একটা ডানা। চেরা ডানা নিয়েই পাখিটা উড়লো আরো কিছুদুর। তারপর কাতরাতে কাতরাতে, আকাশ থেকে নামতে নামতে এসে পড়লো একটা ডাস্টবিনে।  সেখানে খাবার খুঁজছিল একটা ময়লা হয়ে যাওয়া বুড়ো। বুড়ো পাখিটাকে হাতে তুলে নিল। ওর ডানায় হাত বুলিয়ে বললো "আহা! বড় আঘাত লেগেছে তোমার!" তারপর পাখিটার ঠাঁই হলো ব্রিজের নিচে একটা ময়লা ছেঁড়া কাঁথার ওপর। বুড়ো ওকে আধ খাওয়া একটা বারগার থেকে খুঁটে একটু একটু খেতেও দিলো। আর মুখে বললো "আহা! খুব লেগেছে তোমার? ভেবোনা ঠিক হয়ে যাবে। সব আঘাত ঠিক হয়ে যায়।" আবার একটু ভেবে বললো "কিন্তু আবার কোন আঘাতই ঠিক হয়ে যায়না, বুঝলে? না হলে নেই। জীবন... বুঝলেতো ছোট্ট সোনা পাখি... জীবনের কিছুতেই কিছু যায় আসেনা", বলেই একটা দীর্ঘ‍্য নিঃশ্বাস ফেললো। পাখিটা কি বুঝলো কে জানে, চোখ থেকে তার এই প্রথম একফোঁটা জল গড়ালো। বুড়োটা এবারে ঝোলা থেকে বের করলো একটা আধখাওয়া কোকের বোতল। ঢকঢক করে খেয়ে নিল প্রায় পুরোটা। পাখিটাকেও কফোটা দিল। তারপর পকেট থেকে একটা গাঞ্জাভরা কাঠি বের করে ধরালো। বেশ লম্বা লম্বা সুখটানে  আবহটাকে একই সাথে হালকা ভারী আর ঝাপসা করে তুলতে লাগলো। পাখিটারও যেন একটু নেশা ধরে গেল আর পাখনার যন্ত্রণাটা কম কম বোধ হলো। বুড়োটা অনেক গল্প করলো। বললো এই রাস্তাটায় কারা যায়, ট্রাফিক পুলিশগুলো কেমন, ওর জীবন কেমন কাটছে, কারা বিরক্ত করে, তাড়া করে, কারা ভালো, ব্রিজটা কতোদিন এভাবেই আধখানা হয়ে পড়ে আছে, কারা ঘুষ খায়, কারা বোমা মারে, মিছিলে সবাই কি বলে, বৃষ্টির দিনে কি হয়, ফেরিওলাগুলো, ভিখিরিগুলো, কুকুরগুলো, কাকগুলো, ইত‍্যাদি...ইত‍্যাদি...। পাখিটা সব মন দিয়ে শুনলো আর মনে মনে ভাবলো 'আজ তীরটা যদি না লাগতো, এমনি জখম হয়ে যদি ডাস্টবিনে না পড়তাম, এতো জ্ঞানের কথা কি আর শুনতে পেতাম জীবনে?' এইসব ভাবতে ভাবতে পাখিটা একটা বুঝদারের আত্মতৃপ্তি নিয়ে ভাঙা ব্রিজের ফাঁক দিয়ে ছোট্ট আকাশটা দেখতে লাগলো। হঠাৎই ওর চিন্তায় ছেদ পড়লো কারন কানে এলো বুড়ো একটা গান ধরেছে। দুহাতে একজোড়া মন্দিরা বাজাতে বাজাতে বুড়ো একটা ভজন গাইছে বড় দরদি গলায়। পাখিটার গান শুনে বুকটা হুহু করে উঠলো আর দুচোখ বেয়ে অঝোরে জল গড়ালো। গান শেষ হলে বুড়ো বললো "হ‍্যাঁরে পাখি কাঁদছিস তুই? দুঃখ কি তোর? ওইতো একটা ডানা, সেরে গেলে উড়ে যাবি আবার। জানিস কতো একলা আমি? সবাই ছেড়ে গেছে। এই গান ছাড়া আর কিছুই পড়ে নেই।" পাখির বড় কষ্ট হলো বুড়োর জন‍্য। ভাবলো ডানা সেরে গেলেও ছেড়ে যাবেনা বুড়োকে। এভাবে দুদিন গেলো। বুড়ো পাখিটার সঙ্গ পেয়ে বেশ আনন্দে ছিল। বহুদিন পর গোসল করলো, ঝোলায় থাকা কমলা গেঞ্জিটা বের করে পরলো, চুল আঁচড়ালো, একজোড়া চলটা ওঠা চামড়ার বুটও পরে নিলো। তারপর আবার দুপুরের পর গাঞ্জা টেনে গল্প জুড়ে একটু দম নিয়ে একটা গান ধরলো মন্দিরা হাতে। কিন্তু আজ ধরলো  রাধাশ‍্যামের গল্প বলা একটা মনভোলানো ঝুমুর গান। মন্দিরাটা বেশ কায়দায় বাজাতে বাজাতে সারা শরীর দোলাতে দোলাতে গাইতে লাগলো বুড়ো। এমন মজার গান শুনে পাখির মনও খুশিতে মেতে উঠলো। আনন্দে বিভোর হয়ে পাখিটা বুড়োর চারপাশে ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগলো আর গলা মেলাতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ‍্যেই হঠাৎ বুড়ো গান থামিয়ে দিলো। মন্দিরাজোড়া আছড়ে ফেললো হাত থেকে। কি কারনে কে জানে যেন ভীষন রেগে থম মেরে বসে রইলো রাস্তায় স্থির দৃষ্টি রেখে। এইসব দেখে পাখিটা ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। ভয়ে গুঁটিশুঁটি মেরে ছেঁড়া কাঁথাটার এক কোনে বসে পড়লো আর বুড়োকে ভয়ে ভয়ে দেখতে লাগলো। এভাবে সন্ধ‍্যা গড়িয়ে রাত নামলো। বুড়ো একইভাবেই রেগে বসে রইলো। পাখিটা চুপচাপ পড়ে থাকতে থাকতে একটা সময়ের পর ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুমের মধ‍্যেই হঠাৎ বুঝতে পারলো বুড়োটা ওকে দুহাতে চেপে ধরেছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুড়ো একহাতে পাখিটার ঘাড় মটকে দিলো। বিষ্ফারিত চোখে বুড়োর মুখটা দেখতে দেখতে পাখিটা আবার ঘুমিয়ে পড়তে লাগলো। ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে একটা স্বপ্ন দেখলো ছোট্ট পাখিটা। দেখলো সে আসলে একটা ফিনিক্স পাখি জ্বলন্ত ছাই থেকে সোনালি মজবুত দুটো বিশাল ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে আবার জন্ম হচ্ছে তার, যে ফিনিক্সে পাখির গল্প সন্ধ‍্যাবেলা ঘরে ফিরে বাবা কিংবা মা বলতো ওদের কানে আর ওরা ধীরে ঘুমিয়ে পড়তো, যদিও তখনও চোখ ফোটেনি মোটে।





No comments:

Post a Comment

English Translation of Bangla Folk Song: Fakir Lalon Shah; চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি; Forever I Nurtured a Mysterious Bird

 Forever I Nurtured a Mysterious Bird Forever I nurtured a mysterious bird, which never discloses its identity. For this grief, my eyes ...