"আচ্ছা, দেয়ালের উল্টোদিকে কি আছে আপনি জানেন?" নিজেকে বারবার করা প্রশ্নটাই করলো রুতমিলা শুভকে। শুভ বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন ছেলে, এইসব খেয়ালি প্রশ্নে সাধারনত ওর বিরক্তিই বোধ করবার কথা। রুতমিলার মতো একটা আধপাগলা হেলুসিনেটিভ মেয়েকে প্রায় বছর তিনেক আগে পাভেলদের এনিভার্সারির পার্টিতে ভালো লেগে গিয়েছিল হঠাৎ। সেদিন অবশ্য রুতমিলা খুব সপ্রতিভ ছিল, একটা পার্টিতে আকর্ষণের কেন্দ্র হবার জন্য ওর সব গুণই কম বেশি সবার দৃষ্টি কেড়েছিল। পাভেলের স্ত্রী বিভা কোত্থেকে ওকে পেয়েছিল কে জানে, সেদিনই প্রথম উদয় হয়েছিল মেয়েটা। আর যেমনি উদয় হয়েছিল তেমনি হারিয়েও গিয়েছিল। শুভ প্রথমে রুতমিলাকে সোস্যাল নেটওয়ার্কগুলোতে খোঁজ করেছিল তারপর না পেয়ে বিভাকেই জিজ্ঞেস করেছিল ওর ব্যাপারে। অন্তঃর্মূখী শুভ বিভার কাছে কোন একটা মেয়ের খোঁজ করছে বন্ধুচক্রে মুহূর্তেই চাউর হয়ে গেলো কথাটা বটে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। কারন বিভা বললো ডিজাইনার্স এ্যাসোসিয়েশানের একটা মিটটুগেদার ওর রুতমিলার সাথে ওর আলাপ। কনটেমপোরারি মারকেট'স বিহেবেরিয়াল চেইঞ্জেস এবং ফিউচার ট্রেন্ড ফোরকাস্টিং এ রুতমিলার অত্যন্ত পরিষ্কার চিন্তাভাবনা শুনে অন্য সবার মতো বিভাও আকর্ষিত হয়েছিল। নিজে থেকেই আরো একটু আলাদা করে আলাপ করে নিয়েছিল তাই আর আন্তরিকভাবে ওকে আমন্ত্রণও জানিয়েছিল ওদের প্রথম ম্যারেজ এনিভার্সারির পার্টিতে। রুতমিলা এসেওছিল আর ফিরে গিয়ে একটা আন্তরিক ধন্যবাদ টেক্সটও করেছিল। তারপর থেকে আর কোন যোগাযোগ হয়নি ওদের। থাকার মধ্যে আছে শুধু একটা বিজনেস কার্ড যাতে ছাপা আছে একটা ইমেইল আইডি, একটা মোবাইল নাম্বার আর কয়েকটা ওয়েব এ্যাড্রেস। বিভা সেই বিজনেস কার্ডটাই তুলে দিয়েছিল শুভর হাতে। কার্ডটা হাতে নিয়ে দেখলো শুভ, শেডেড নীল রঙের, গতানুগতিক বিজনেস কার্ডের মতো নয়, কিছু একটা শৈল্পিক ও অপ্রতিম ব্যাপার আছে কার্ডটাতে নিশ্চিতভাবেই। ইংরেজিতে লেখা রুতমিলা আহমেদ, ফ্রিলেন্স ডিজাইন কনসালটেন্ট, কয়েকটা ওয়েব এ্যাড্রেসের মধ্যে একটা হলো লাইফস্টাইল ভ্লগ, একটা সম্ভবত ক্রিয়েটিভ রাইটিং ব্লগ। বিভা দুষ্টু হেসে বলেছিল "এ্যাতো বছরে এই প্রথম আপনাকে কোন মেয়ের খোঁজ করতে দেখলাম শুভভাই। বেস্ট অব লাক!" শুভ বিব্রত বোধ করছিল, তারপরও পরদিন দুপুর তিনটের দিকে কল করলো মোবাইল নাম্বারটাতে কিন্তু ওপাশ থেকে গ্রামীণের সুইচড অফ ইন্ডিকেটিং ম্যাসেজটাই বেজে উঠেছিল। তারপর বিকেল পাঁচটায়, সন্ধ্যে সাতটায়, পরদিন, তার পরদিন, পরপর সাতদিন কল করে গিয়েছিল শুভ নাম্বারটাতে। কিন্তু প্রতিবারই সেই পুরোনো সুইচড অফ রেকর্ডটাই বেজে গিয়েছিল। বিভাকে জিজ্ঞেস করতেই বলেছিল "নাম্বারটা তো ঠিকই আছে। কারন এই নাম্বারেই কথা বলেছি একবার ওর সাথে আর সেদিনের পার্টির পর ও ম্যাসেজও করেছিল এই নাম্বারটা থেকেই। চিন্তা করবেন না শুভভাই। দেশের বাইরেও তো গিয়ে থাকতে পারে। আর আপনি যখন খোঁজ করছেন ওকে ঠিক খুঁজে বের করবো। যাবে আর কোথায়? এইতো ছোট্ট একটা কমলালেবুর মতো পৃথিবী। হাহাহাহা...." শুভ এই পুরো ব্যাপারটাতেই আরো বিব্রত হয়ে পড়েছিল। শুভ বরাবরই অহংকারী ও আত্মনিমগ্ন ব্যাক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত বন্ধুদের কাছে। পরিবারের ব্যাবসা এবং নিজের প্রিয় কাজগুলোতে সময় দিতেই সাধারনত ব্যাস্ত থাকে রাতদিন। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে, ঘুরে বেড়াতে বেশ পছন্দ করে অবশ্য, বন্ধুরাও ওকে ভালবাসে ওর ক্রিয়েটিভিটি আর সেন্স ওব হিউমারের জন্য। কিন্তু সবকিছুর পরও নিজের ব্যাক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, আবেগ-অনুভুতিগুলো নিজের মধ্যেই রাখতে চায় যতোটা পারে। ঠিক করলো রুতমিলা মেয়েটার নাম আর কখনো মুখেই আনবে না আর কল তো করবেই না কখনো ওই নাম্বারটাতে।
শুভর দিনকাল ব্যাস্ততার মধ্যেই কাটছিল। মাঝে বছর দেড়েক কেটেও গিয়েছিল। এরমধ্যে সিলভিয়ার সাথেও সম্পর্ক গড়ে উঠলো একরকম পারিবারিকভাবেই। বাবার বন্ধু ও প্রাক্তন বিজনেস পার্টনার আজমল চাচার মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই পারিবারিকভাবে যোগাযোগ ছিল কিন্তু গত পনের বছর ধরে আজমল চাচা তাঁর পরিবার নিয়ে কানাডাবাসী হয়েছেন। মাঝেমধ্যে বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছেন কিন্তু শুভর সাথে দেখা হয়নি। তা এইবার তিনি বেশ লম্বা সময় ও পরিকল্পনা নিয়ে দেশে এসেছেন এবং একমাত্র মেয়ে সিলভিয়াকে উপযুক্ত পাত্রস্থ করে তবে ফিরবেন বলে মনস্থির করেছেন। পঞ্চাশ-ষাটোর্ধ আধুনিক বাংলাদেশী বাবারাও কি এক অদ্ভুত কারনে তাঁদের মেয়েদের ব্যাপারে হঠাৎই কেন এরকম রক্ষণশীল ও সেকেলে হয়ে ওঠেন তা শুভর বোধগম্য নয়। সে যাই হোক, সিলভিয়াকে শুভর ভাল লেগেছে, সত্যি বলতে ওকে ভাল না লাগার কোন কারন বের করাই মুশকিল যে কারো জন্যই। একরকম সে কারনেই খুব তাড়াতাড়িই ধুমধাম করে ওদের এনগেইজমেন্টটাও হয়ে গেল। ঠিক হলো মাস চারেক পর শীত পড়লে আর মোটামুটিভাবে প্রায় সব প্রবাসী আত্মীয়স্বজনরা নানান দেশ থেকে আসতে পারলে ওদের বিয়ের অনুষ্ঠানটাও জাঁকজমকের সাথে উদযাপন করা হবে।
পারিবারিকভাবে এনগেইজড হলে যা হয় এই দেশে, সিলভিয়া আর শুভ অবাধে ডেট তো করতেই লাগলো আর যাতায়াতও করতে লাগলো একে অপরের বাড়ি। প্রতিনিয়তই চলছে পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের নিত্যনতুন প্ল্যানিং। সিলভিয়া পুরো বিষয়টাতেই খুব উদ্বেলিত। দীর্ঘ্যদিন প্রবাসে থাকায় এদেশের প্রতিটি উৎসবই ওর কাছে ভীষণভাবে জড়িত ও মত্ত হয়ে পড়বার উপলক্ষ্য মাত্র। কদিন পরপরই সিলভিয়া চলে আসে শুভদের বাড়ি কিংবা হ্যাঙ্গআউট করে শুভর বোনদের সাথে। বলা বাহুল্য শুভর ছোট দুই বোনের সাথে ইতিমধ্যেই ওর অনেক বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে, তা যতোটা না বাগদত্বা হবার কারনে তার চেয়েও বেশী ওদের ডেস্টিনেশান ওয়েডিং প্ল্যানিঙের জন্য, অন্তত শুভর তাই ধারনা। যেভাবেই হোক না কেন একটা তাক লাগানো পাঞ্জাবিস্টাইল এবং একই সাথে সফিসটিকেটেড পাঁচদিনব্যাপী ওয়েডিং সেরেমনি করতে হবে। এমনি একদিন সিলভিয়া এসেছে ওদের বাড়ি। শুভর ঘরে ওর বুকশেলফ থেকে একটা দুটো বই হাতে নিয়ে দেখছে আর টুকটাক নৈমিত্তিক কথাবার্তা চালাচ্ছে দুজন, এরই মধ্যে বোদলেয়ারের কবিতা সংকলনটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখবার সময় কিছু একটা পড়ে গেল মেঝেতে। সিলভিয়া উৎসুক হয়ে হাতে তুলে নিয়ে দেখলো বিজনেস কার্ডটা আর ভালো করে দেখে নিয়ে শুভকে জিজ্ঞেস করলো "রুতমিলা আহমেদ, তোমার বন্ধু?" বছর দেড়েকেরও বেশি দিন পর নামটা হঠাৎ শুনে হকচকিয়ে গেল শুভ। ল্যাপটপে একটা জরুরী ইমেইল লিখছিল কিন্তু নামটা শুনে চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো সিলভিয়ার দিকে। ওর হাতে সেই নীল রঙের বিজনেস কার্ডটা, কতোবারই না খুঁজেছিল কার্ডটা বছরখানেক আগেও, কিন্তু কোত্থাও খুঁজে পায়নি। হকচকানো ভাবটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে স্বাভাবিক গলাতেই বললো "না। বন্ধু না। একবার খালি দেখা হয়েছিল একটা পার্টিতে।" সিলভিয়া যেন হতাশ হয়েই বললো "ও! আমি ভাবলাম আপনার বন্ধু। শুনেছি বাংলাদেশেই থাকে এখন বেশ কবছর ধরে।" শুভ অনুসন্ধিৎসু হয়ে জিজ্ঞেস করলো "তুমি চেনো না কি ওকে?" সিলভিয়া হড়বড় করে বলতে লাগলো "আরে চিনি তো বটেই। শি ওয়াজ ইন মাই হাইস্কুল। হোয়াট টু সে... শি গট বুলিড এ লট, বয়েজ এন্ড গার্লজ ইউজড টু কল হার কোকুন হেডেড উইচ। ওর মা ছিল একটা এ্যাংলো ইন্ডিয়ান কফি রিডার ওল্ড উমেন, বাবাটা বোহেমিয়ান লুকড, পরে জেনেছি বাংলাদেশী... সাম আহমেদ। থাকতো আমাদের টু ব্লকস পরেই। আমরা যখন নাইনথ গ্রেডে হার মম ওয়াজ মারডারড বাই সাম মাফিয়া। এভরি এ্যালেবাই অল এট ওয়ান্স ওয়াজ জাস্ট গট ভ্যানিশড। ওর বাবাটা ওকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল তখন। আফটার টেন ইয়ারস ওয়ান ওব মাই ফ্রেন্ড সও হার ইন আ ফ্রেঞ্চ ফ্যাশন ডক্যুমেনটারি। শি গট আ লট অব অ্যাপরেসিয়েশান ফর হার ডিসটিঙ্কটিভ ওয়ার্ক অন... হোয়াট ইটস কলড... আঁ... হাঁ...বাংলাদেশী খাদি কনজারভেশান অ্যান্ড সাসটেইনেবল ফ্যাশন থটস ইন এ্যকশান।" এই পর্যন্ত বলে সিলভিয়া থামলো। শুভ একরকম স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সিলভিয়ার বড় বড় চোখদুটোর দিকে। তারপর অস্ফুটে শুধু বলে উঠলো "ওহ! আচ্ছা।" সিলভিয়া বেশ আগ্রহী গলায় বললো "ক্যান উই ইনভাইট হার ইন আওয়ার ওয়েডিং প্রোগ্রাম? এ্যান্ড... ক্যান ইউ ডু ইট ফর মি?" শুভ হাত বাড়িয়ে সিলভিয়ার হাত থেকে বিজনেস কার্ডটা নিল আর কার্ডটার ওপর চোখ রেখেই আস্তে আস্তে বললো "শিওর! হোয়াই নট?" শুভর ছোট বোনটা এসে তখনই সিলভিয়াকে ডেকে নিয়ে গেল ওদের ঘরে।
সেদিন রাত পর্যন্ত শুভ আর কোন কাজেই মন দিতে পারলো না। সিলভিয়ার সাথে ডিনারের প্ল্যানটাও ক্যানসেল করলো মাথা ব্যাথার দোহাই দিয়ে। কি হলো কে জানে সারারাত ঘুমোতেও পারলো না। পরের তিনদিন নিজ থেকেই ডে অফ নিয়ে নিল আর চলে গেল সমুদ্র দেখতে একলা একলাই কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে।
পরের ঘটনাগুলো যেন খুব দ্রুতই ঘটে গেল। শুভ ফিরে এসে সিলভিয়াকে এবং পরিবারের সবাইকে জানালো যে এই বিয়েটা করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। দুই পরিবারের মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়লো যেন। সিলভিয়ার মন ভেঙ্গে হয়তো টুকরো টুকরো হয়ে গেল। আজমল চাচা তাঁর স্ত্রী এবং সিলভিয়াকে নিয়ে যত দ্রুত পারলেন কানাডা ফিরে গেলেন। বাবা তার অপ্রতিম বন্ধুকে চিরকালের জন্য হারালেন ভেবে মুষড়ে পড়লেন। মা ও বোনেরা কয়েক মাস ধরে শোক করলো। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবরা হতাশ হলো কমবেশি। আর শুভ আবার কাউকে কিছু না জানিয়ে বেরিয়ে পড়লো কোথাও একটা।
আজ এক সপ্তাহ হলো শুভ রুতমিলাকে খুঁজে পেয়েছে। চাইলে আরো আগেই খুঁজে পেতো কিন্তু রুতমিলাকে খুঁজে পাবার আগে ওর হয়তো নিজেকে খুঁজে পাওয়াটা অনেক বেশি জরুরী ছিল। গতকাল সেই পুরোনো মোবাইল নাম্বারটাতে ফোন করতেই রুতমিলা রিসিভ করেছে। ওরা সারারাত কথা বলেছে দুজন অনেকটা বিকারগ্রস্তের মতোই। আজও বলছে বিকারগ্রস্তের মতোই, আর তারই মাঝে রুতমিলা হঠাৎই শুভকে প্রশ্ন করলো "আচ্ছা, দেয়ালের উল্টোদিকে কি থাকে আপনি জানেন?" শুভ বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন ছেলে, এইসব খেয়ালি প্রশ্নে সাধারনত ওর বিরক্তিই বোধ করবার কথা। কিন্তু শুভ আবেগঘন গলায় উত্তর দিল " আপনার দেয়ালের ঠিক উল্টো দিকে আমার দেয়াল আর আমি। আপনি যদি বলেন আমি এই দুটো দেয়ালই ভাঙতে রাজি আছি।"
No comments:
Post a Comment