Sunday, December 20, 2020

গল্প : দুই : ফাটল

মনার মা তার পরিবার নিয়ে থাকতো আমাদের আউটহাউজে সার্ভেন্ট'স কোয়ার্টারে। বয়স তিরিশের কোঠায়, গায়ের প্রকৃত রং ঠিক বোঝা যেতনা তবে হয়তো কোনকালে হলদে ফর্সাই ছিল। বয়সের কারনে যতনা বলি রেখা পড়েছিল ওর একটু চাপা গালের হাড় বেরোনো চৌকোনো মুখমন্ডলে তার চেয়েও বেশি পান খেতে খেতে। সরু কপালেও সেঁটে বসে গিয়েছিল গভীর ভাঁজ আর ছোটো ছোটো চোখগুলোর নিচেই ছড়িয়ে থাকতো থ‍্যাবড়া নাকটা। পান খেতে খেতেই হয়তো ঠোঁট জোড়া অমন মরচে রঙের হয়ে গিয়েছিল। উচ্চতা পাঁচ ফুটের কিছু কম কিন্তু চ‍্যাপ্টা চৌকোনো বজ্রআঁটুনির শরীরে তার যে দৈহিক শক্তি প্রকাশ পেতো তাতে উচ্চতার কমতিটা তেমন একটা গ্রাহ‍্য হতনা। আঁটসাঁট হাতখোঁপা আর বড়বড় ফুলের নকশাওলা উজ্জ্বল রঙের ছাপা শাড়িতে তার ছিল একেবারে খাঁটি বাংলাদেশী খেটে খাওয়া শরীর। এমনিতে গম্ভীর হয়েই থাকতো আর কাজ করে যেতো মন দিয়ে কিন্তু মাঝেমধ‍্যে কথা বলবার সময় উচ্ছসিত হয়ে উঠলে বড় বড় সিঁটে পড়া দাঁতগুলো বের করে হাসতে থাকতো হে হে হে আওয়াজ তুলে আর তারপরই মরিচা রঙের জিভটা বের করে ঠোঁটের কোণ গলে বেরিয়ে যাওয়া পানের পিক চেটে নিত। গলার আওয়াজটা তার এতোটাই বাজখাঁই আর ফ‍্যাসফ‍্যাসে যে আমাদের সেই চুপচাপ নিমগ্ন পাহাড়ি পরিবেশের জন‍্য বেমানানতো ছিল বটেই একেবারেই যেন ছিল কোন এক ভয়ানক দস‍্যুর ত্রাস। হঠাৎ হঠাৎ ওর আমোদ পাওয়া হাসির শব্দ যেন ফালাফালা করে দিত শান্তিপূর্ণ ভদ্র সম্ভ্রান্ত রুচিশীল অপার প্রাকৃতিক প্রাচুর্যভোগী আমাদের ওই সোসাইটিটা। আমরা ওটাকে রেসিডেন্সিয়াল সোসাইটিই বলতাম কারন অফিসার্স বাংলোগুলো ছিল বেশ দূরে দূরে আর প্রতিটিই ছিল সুযোগ সুবিধায় স্বয়ংসম্পূর্ণ, পাড়াগুলোর মতো প্রাণচাঞ্চল‍্য, সৌহার্দ‍্য বা বিতন্ডা কিছুই এখানে ছিলনা। প্রতিটি বাংলোই তার ভেতরে এক বা একাধিক হাতি লুকিয়ে রাখতো, শিল্পসংস্কৃতি ও ধর্মের চর্চা করতো আর একে অন‍্যের সাথে এক পরিশীলিত বরফঠান্ডা প্রতিযোগিতা বিদ‍্যমান রেখে যেতো। অধিবাসীদের বেশিরভাগের মূলত অবসর কাটতো ক্লাবঘরে তাসের আড্ডায় নিষিদ্ধ ব্র‍্যান্ডেড মদ আর দারুন মুখরোচক সব সান্ধ‍্যকালীন নাশতার সাথে। ওদের প্রত‍্যেকেরই ছিল উপদেশমূলক গল্পের শেয়ালের মতো প্রখর সময়োপযোগী চাতূর্য আর  একটা করে অদৃশ‍্য মাছি তাড়ানোর লেজ। 


বলছিলাম মনার মায়ের কথা, সে যে কবে কেমন করে এই তল্লাটে এসে পড়েছিল সুদূর ভোলা থেকে, তার শৈশব কৈশোর কেটেছিল কোথায়, আদৌ লেখাপড়া কিছু জানতো কি না, বাবা মা আত্মীয় স্বজন ছিল কি না বা থাকলেও কোথায় থাকতো, মনার বাপের সাথে তার কি করে দেখা হলো বা বিয়ে হলো কিংবা ওর বাপমায়ের রাখা নিজের নামটাই বা কি এইসব ব‍্যাপারে আমাদের আগ্রহ কখনো ছিলনা বা কোনো প্রশ্নও কোনোদিন মাথায় আসেনি। আমি ওকে শুধু জানতাম ওই বিশাল বিলাতি বাড়িটার অন‍্য আর সব সুবিধার মতোই যখন থেকে আমি রাতদিন ব‍্যস্ত থাকতে শিখে গিয়েছিলাম অদ্ভুত সব আত্মমগ্ন বই, লেখার খাতা, ক্রেয়নে আঁকা ছবি, ধ্রুপদী ও রকমারি নাচগান, টিভি, যত রাজ‍্যের দুষ্টুবুদ্ধি আর জটিল চিন্তাভাবনা নিয়ে। আমার ছোট ভাইটা তখন little miss muffet, dingdong bell কিংবা মনারে মনা কোথায় যাস বলে বলে অনেক বাহবা হাততালি চটকানো ধরনের আদর  পাচ্ছিল। বোনটা কি যেন দুশ্চিন্তায় ডুবে থাকতো তখন আর এই ইবলিশ ভাইবোনদের অত‍্যাচারে ওর মতো মাবাবার আদর্শ  লক্ষী মেয়েটার জীবনটা যে কতটা অতিষ্ট তা ওই তল্লাটের সব মানুষ গরু কুকুর বিড়াল পাখি এমনকি গাছপালারাও জানতো। বড় ভাইটা এতটাই বড় ছিল যে ওর একেবারে নিজেরই একটা জগত ছিল আর ওর মেনিমুখো বাঁদরমুখো ইঁদুরমুখো বন্ধুগুলোর সাথে কি যে করতো সারাদিন আর কই কই যে ঘুরতো আমাদের অনেক আগ্রহ থাকা সত্বেও কিছুই জানতে পারতাম না। ওরা শুধু মাঝেমাঝে দল বেঁধে গেঁড়ে বসতো আমাদের সবুজ বসার ঘরে (আমাদের মত বাচ্চারা যেখানে গেলেই দুরদুর করে তাড়া খেতাম), গান্ডে পিন্ডে গিলতো আর তারপর দল বেঁধে আবার কোথাও বেরিয়ে পড়তো। একটাই শুধু যোগ ছিল ওর সাথে যখন আমরা বেচারি বোনটার পেছনে লাগতাম তিনজন মিলেই আর যখন WWF মুভগুলো প্র‍্যাকটিস করতাম। তখন অবশ‍্য আমি আর আমার ছোট ভাইটি একজোট  হতাম আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুদিক থেকে বড় ভাইটার ওপর "ইয়া...." বলে ঝাঁপিয়ে পড়তাম আমাদের ছোটছোট কোনুইগুলো তাক করে। কিন্ত সত‍্যি বলতে কি আমি ছিলাম বড্ড বেশীই খামখেয়ালি এবং আনমনা। ক্লাসের পড়াশুনা নিজের কাজ বা ঘরের কাজে সাহায্য করবার ব‍্যাপারে ফাঁকিবাজ আখ‍্যা পেলেও মূলত ছিলাম চরম উদাসীন। আমার বোনটা, যেকিনা মাত্র সাত কি আট বছর বয়সে ছোট্ট আমাকে আগলে রাখতে শিখেছিল আর ওই বয়সেই হয়ে উঠেছিল মা আর দাদী নানীর মতো, বলতো "দাঁড়াও আমি একটা গল্প বলি তুমি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তো", সেই মূলত আমার রাজ‍্যের জিনিসপত্তরগুলো গুছিয়ে রাখতো আর মাঝেসাঝে চুলে তেলও লাগিয়ে দিতো। মনার মা, জানিনা ঠিক, বোনটার প্রতি দয়াশীল হয়ে নাকি আমাকেই ভালবেসে না গৃহকর্ত্রীর হুকুমে, কি কারনে কখন যে আমার জিনিসপত্তর গোছাতে শুরু করলো মনে নেই। আর যতই বড় হতে থাকলাম সে যেন কড়া নজরে নজরে রাখতে শুরু করলো। আমার নিত‍্যনতুন খেয়াল, দুষ্টুবুদ্ধি আর উদাসীনতায় সে যেন মায়ের চেয়ে কম বিরক্ত ছিলনা। এতোগুলো বছরে সে নিজেকে ঠিক কোন জায়গাটাতে দেখতে অভ‍্যস্ত হয়ে পড়েছিল তা কখনো খেয়াল করিনি বরং বিরক্তই হতাম কারন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবার সময় এমন কি ফোনে কথা বলবার সময়ও যেন নজর রাখতো আর বোঝার চেষ্টা করতো হালচাল। আর আমার বন্ধুরা এলে কি জানি কেন এক নিঃশব্দ বিদ্বেষ  প্রকাশ করতো। আমার মায়ের সাথে তার নিবিড় এক পেশাগত সম্পর্ক ছিল কারন সে কাজেকর্মে ছিল অত‍্যন্ত দক্ষ‍ ওকে ছাড়া মায়ের একদিনও চলতোনা। আরও সাহায‍্যকারীরা থাকলেও মনার মা ছিল একাই একশ। অতবড় বাড়িটা পরিষ্কার পরিপাটি রাখার জন‍্য আর গুষ্টির লোকের প্রতিদিনের আরামআয়েশ ও পাঁচবেলা ভুরিভোজ যোগাড়ের জন‍্য আমার মায়ের সবচেয়ে অপরিহার্য কাজের ঘোড়া ছিল মনার মা। আর পরিষ্কারের দক্ষযজ্ঞ এমনই ছিল যে মাসে দু'মাসে একবার যেদিন পুরো বাড়িটা ছাদ থেকে মেঝে পর্যন্ত সাফ করা হতো আমরা (অন্তত আমি) সব বাড়ি ছেড়ে পালাতাম আর একেবারে সন্ধ‍্যা করে ফিরতাম। শুধু একটাই সমস‍্যা ছিল, মাঝে মাঝে হঠাৎই মনার মা এমন এক আজব যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ রসিকতা করে বসতো যে লোকে কিছু বলবে কি একেবারে হাঁ হয়ে যেতো। আর তার লাম্পট‍্যভরা চোখ আর দাঁত নিয়ে এমনভাবে হাসতে থাকতো, অন‍্যদের কথা জানিনা কিন্তু গৃহকর্ত্রীর যে তার এমনতর নোংরামিপূর্ণ ঔদ্ধত‍্যে পায়ের নিচের মাটি কিছুটা হলেও সরে সরে যেতো তা নিশ্চিত। যেমন ধরুন মা যখন আমাদের সরকারি ড্রাইভারটিকে নিয়ে অভিযোগ করতো তার মেজাজ খারাপ করা বেয়াড়া জমিদারপোসুলভ আচরনের জন‍্য, সেই প্রচন্ড খারাপ মেজাজের মূহুর্তে সে হয়তো হে হে হে করে হেসে বলে বসতো "হুনেন খালাম্মা, হেই ব‍্যাডার দাফট সবই দ‍্যাখাইন্না... হে হে হে...আমি কইতে ফারাম হেই ব‍্যাডার শইল্লে কয়ান আড্ডি আছে আর হ‍্যায়ও কইতে ফারবো আমার শইল্লে কয়ান আড্ডি আছে...হে হে হে..."। মনার মা তার লাম্পট‍্য নিয়ে অনেক রসালো গল্প নিজেই সকলকে বলে বেড়াতো। ওর লাম্পট‍্য নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ ছিলনা তেমনি ওর দক্ষতা ও পবিত্রতা নিয়েও কারো কোনো সন্দেহ ছিলনা। কোথা থেকে যে সে এক প্রকার ভেষজ জ্ঞান পেয়েছিল কে জানে? সে ঠিক জানতো পাহাড়ে কোথায় কোন গাছ লতাপাতা বা মূল আছে যা দিয়ে সেরে যায় দাঁতের ব‍্যাথা, দীর্ঘ‍্যমেয়াদী পেটের অসুখ, আহ্নিক জ্বর কিংবা গর্ভকালীন জটিলতা। ঠিকায় সে স্বল্পখরচের ধাত্রী,  ডাক্তার ও ওঝারও কাজ করতো। দূর দূর থেকেও গরীব লোকজন আসতো ভেষজ ওষুধ, তাবিজ কবচ আর পানিপড়া নিতে। হঠাৎ হঠাৎ কোনো একদিন সে ধবধবে সাদা থান পরে একটানা নামায পড়ে যেত আর বিড়বিড় করতো ঘন্টার পর ঘন্টা। প্রতিবেশীরা এইসব ভৌতিক কান্ডকারখানায় ভয় পেয়েও যেত আবার ভীড় জমিয়ে দেখতোও। প্রচলিত ছিল যে ওর কথা না কি অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায় আর ওকে গালমন্দ করলে শাস্তি অনিবার্য। তাই সবাই ওকে সমীহ করে চলতো আর প্রবল মৌলবাদি লোকটিও এমন লম্পট চরিত্রহীন বেয়াদব খানকিটাকে মনে মনে দূর্বিসহ ঘৃণা করলেও পাথর ছুঁড়ে, কুপিয়ে বা জীবন্ত কবর দিয়ে মারার কথা মুখে আনতো না। মনার মার সগর্ব পদচারনা ছিল পুরো এলাকাতে আর প্রতিটি বাড়ির হাতির খবর সে কেমন করে জানি জানতো তাই কেউ তাকে ঘাটাতোও না। 


মনার মার বর, মনার বাপটা কালেভদ্রে রিক্সা চালাতো। বাকি সময়গুলো তার ইয়ার দোস্তদের সাথে জুয়া খেলতে খেলতে, বাংলা খেয়ে আর না জানি আর কত কি নেশা ভাং করতে করতে কেটে যেত বেচারা হয়তো বুঝতেও পারতো না। বউ যখন আর সইতে না পেরে গাল পাড়তে শুরু করতো চিৎকার করে আর চ‍্যালাকাঠ নিয়ে তেড়ে আসতো তখন সে ঘর থেকে বেরিয়ে যেত আর মাত্র ক'ঘন্টায় শ দু'তিন টাকা কামিয়ে ফেলতো তারপর সে টাকায় রাজ‍্যের খাবারদাবার কিনে এনে ঘরে রীতিমতো একটা ভোজ বসিয়ে ফেলতো, তখন বউছেলেমেয়েদের আশ্বাস দিয়ে বলতো "এতো গরম হস ক‍্যান? আমি কি মইরা গেছি নি?" তারপরের কয়েকদিন আবার হয়তো তার শুধু ঘুমিয়েই কেটে যেত। ফুলকড়ই গাছের ছালের মত অন্ধকার গায়ের রঙ আর একহারা বেশ লম্বা গড়ন ছিল মনার বাপের। এমন হাতুড়ি পেটানো শরীর ও মুখোমন্ডল ছিল তার যে সাদারা দেখলে হয়তো বলতো 'BlackNutStick'। বাড়ির পেছন দিকে রান্নাঘরের জানলা বা দরজাতে দাঁড়িয়ে নিচে যখন মাঝেমাঝে ওকে দেখা যেত দেখতাম ঠা ঠা রৌদ্রে ওর তেল দেয়া মাথাটা কি ভীষন চকচকে। কাছ থেকে কোনোদিনই ওকে দেখিনি। ওই আউটহাউজের গন্ডি পেরিয়ে চুড়ান্ত অলস নেশাখোর লোকটা কোনোদিন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠেনি। বা আমাদের বাড়ির সামনে যে অবারিত সুন্দর সবুজ ছিল অপূর্ব নীল আকাশ সূর্য চাঁদ আর মেঘেদের নিচে, কৃষ্ণচুড়া দুটো যেখানে  পৌরাণিক নাচের ভঙ্গিতে স্থির হয়ে ছিল, আগুনরঙা ফুলেফুলে ভরে থাকতো আর হয়ে উঠতো সকালে সন্ধ‍্যায় দুরন্ত এক ঝাঁক টিয়েদের ভাব বিনিময়ের স্থান, যেখান থেকে দেখা যেত রহস‍্যময় শহরটাকে, দূরের সমুদ্র রেখা, বাতিঘর আর যেন সবচেয়ে সরু তুলিতে আঁকা কিছু জাহাজের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অবয়ব, সেখানেও মনার বাপকে কোনোদিন চোখে পড়েনি। মনার মা খুব কৃতজ্ঞ এবং গর্বিত ছিল মনার বাপের মরদানা নিয়ে। ওদের ভালবাসাটা ঠিক কেমন ছিল কে জানে, রাতে বেদম ধোলাই খেয়েও মনার মা পরদিন  দুপুরে বিরামহীন পরিশ্রম শেষে নিজের খাবারটা মনার বাপের পাতে সাজিয়ে দিয়ে বাজারে যেত আনাজপাতি কিনতে, কোরবানির গরুর চর্বি সুগন্ধি মশলা দিয়ে ফুটিয়ে জমিয়ে রাখতো সারাবছর মনার বাপ ওর হাতের পরোটা খুব ভালবাসতো বলে, আর রোযার ঈদের আগে আগে নতুন শার্ট আর লুঙ্গির কটকটে রঙগুলো নিশ্চিত করে নিত। ওরা ওদের দায়িত্বহীনতা আর লাম্পট‍্যের বদনাম আর সত‍্যতাকে ঠিক কতোটা ভাগ করে নিত ছোটবড় সব আনন্দ আর চিরপরিবর্তনশীল বাস্তবতার সাথে সাথে কে জানে? বাড়ি ছাড়ার পর একদিন শুনলাম মনার বাপ কিভাবে জানি মরে গেছে। তারপর বছর খানেক পরে আবার জানতে পারি পঞ্চান্ন কি  ছাপ্পান্ন বছর বয়সের মনার মা  আবার বিয়ে করেছে। ওর বেহায়াপনার গল্পে আবার সবাই মেতে উঠেছিল তখন। সে নাকি লাল হলুদ সবুজ আরও কতনা রঙের পাটভাঙা নতুন নতুন শাড়ি পরে পরে সেজেগুজে খোঁপায় ফুল দিয়ে এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারির মাথা খেয়েছিল, বেচারা নাকি তার চেয়ে বয়সে অন্তত দশ বছরের ছোট। ওদের অপবিত্র প্রেম আর অনাচারের জোয়ারে নাকি নব‍্যধার্মিক প্রতিবেশিদের প্রতিনিয়ত দোযখের ভয়ে দিন কাটাতে হচ্ছিল। আমার মায়ের কাছে সব খবর পৌঁছে দিত পুরোনো গৃহপরিচারিকারা যারা ওই এলাকাটা ছেড়ে আসবার পরও প্রতিবছর ঈদের সময় বেড়াতে আসে ওদের উপহার আর পাওনা বুঝে নিতে। ওরা শাপশাপান্ত করে বলতো "মরলে বুজবো খালাম্মা, আগুনে যখন ফুড়বো, কব্বরে হাঁফ খোঁফের কামড় খাইলে বুজবো। আল্লারে! এডি কুনো কতা নি? তওবা আসতাগফিরুল্লা! গজব ফড়বো গজব ফড়বো। আমরা জামাই ফুত ফুতের বউ লই গর করি। এডি দ‍্যাখলে ফোলাফাইন খারাফ অই যাইতো না? আল্লা মাফ করো।" এসব শুনে বুঝতাম বয়স আর অর্থনৈতিক পরিবর্তনের কারনে মনার মার প্রয়োজনীয়তা অনেকের কাছেই আর নেই এখন। আমার মায়ের সাথে মনার মায়ের যোগাযোগটা কোনোদিনই একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। পুরোপুরি ভিন্ন মেরুর দুই দাপুটে অহংকারি মহিলা জীবনের প্রতি তাদের চিরজিজ্ঞাসাগুলোর উত্তরগুলো যতদিন না খুঁজে পাবে এ যোগাযোগ বন্ধ হবার নয় কোনোদিন। আর বদলে যাওয়া বাস্তবতায়, বদলাতে থাকা আত্মার একেবারে বিপরীতধর্মী বিকাশ ও প্রকাশ রোধ করে নাকি তার মুক্তি সহ‍্য করে সমাজ তার চিরসৌকর্য প্রতিস্থাপন করে বা করতে পারে তার উত্তর অন্তহীন সময়ই হয়তো জানে।


মনার মার একটা মেয়েও ছিল আমার চাইতে বছর দুয়েকের ছোট। নাম ছিল জোনাকি। এ ছিল পুরোই 'কানা ছেলের পদ্মলোচন' গোছের নাম, কারন ও পেয়েছিল একদম বাপের মত চেহারা রঙ ফলে অন্ধকারে ওকে একেবারেই দেখা যেতনা। আর পেয়েছিল মায়ের মত কন্ঠস্বর। সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়াতো। চুলগুলো ছিল ওর গলার মতই বাজখাঁই আর উকুনে ভর্তি। সারাগায়ে এত ধুলো নিয়ে ও যে কি করে এত স্বাভাবিক থাকতো এমনকি ঘুমিয়েও পড়তো কে জানে। মা খুব বিরক্ত হতো ও আমাদের বাড়ি আসলে বলতো "মনার মা তোমার মেয়েকে না আনতে নিষেধ করেছি? আর যদি আসতেই হয় যেন পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে আসে।" জোনাকি স্কুলে ভর্তি হলেও ক্লাস মোটেও করতো না। বাপ মা ভাই সবাই মারতো ওকে সকাল দুপুর সন্ধ‍্যা পালা করে আর ও পালিয়ে যেত হাত থেকে, বেশ দূরে দৌড়ে গিয়ে একটু থেমে পেছন ফিরে ভেংচি কাটতো বা কাঁদতে কাঁদতে গালি দিত কিংবা কখনো হেসেই গড়িয়ে পড়তো তারপর আবার ছুট দিত। খুব কম সময়ই সে ওদের ঘরের দরজার সামনে ক্ষয়ে যাওয়া ইটগুলোর ওপর পা ছড়িয়ে জোরে জোরে কাঁদতে বসতো। 


আমার কেন যেন মনে হয়েছিল জোনাকি যদি গান শিখতে পারে তবে তা খুবই সম্ভাবনাময় হতে পারে। ফ‍্যাসফ‍্যাসে জোরালো পরাক্রমশালী পূর্ব এবং পাশ্চাত‍্যের নারীকন্ঠগুলো তখন আমাকে প্রচন্ডরকম বেপরোয়া করে তুলছিল। সবার বিরক্তি রাগ উপেক্ষা করে ধুলোমাখা,  নাকে সর্দিওলা জোনাকিকে ডেকে এনে বসালাম একেবারে আমাদের সংগীত শিক্ষা ও সাধনার চৌকির ওপরে। প্রথমে ওকে হারমোনিয়ামের সাথে তালিম দিলাম শুদ্ধ সুরে আরোহী অবরোহী। ঠিক যুতসই হচ্ছেনা বলে শেখাতে চাইলাম স্বরমালিকা। কিন্তু "|পা নি ধা আ | নি ধা মা পা |" এর অপূর্ব চলন সে বুঝতেই পারছিল না। ভাবলাম এই বুনো মূরগীটাকে শুধু শুধু প্রথমেই সংগীতের ব‍্যাকরণ বোঝাতে যাওয়াটা একটা বাজে আহাম্মকি ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু আমি হাল না ছেড়ে ওর কানের কাছে 'চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে', 'সবে মিলি গা_ও', 'ধনধান‍্যে' বা 'ওই দেখো মা লাল টুকটুক' শতবার গেয়ে চল্লাম আর জোনাকিও অত‍্যন্ত মনোযোগী হয়ে কোথায় কোন স্বরে তারস্বরে চেঁচাতে লাগলো আমি কুল কিনারা হারিয়ে যাচ্ছেতাই হয়ে যেতে লাগলাম। এভাবে কদিন যাবার পর বাড়ির সকলের ওপর চরম নির্যাতন ও পাশবিক বিনোদনে ইস্তফা দিয়ে একদিন আমি মেঝেতেই হাতপা ছড়িয়ে ছাদে স্থির দৃষ্টি রেখে শুয়ে পড়লাম আর শুয়েই থেকেছিলাম দুপুরের খাবারের আগ পর্যন্ত। এর অনেক বছর পর আবার আমার প্রায় এমনটাই অবস্থা হয়েছিল যখন আমাকে বলা হয়েছিল শহরের কিছু সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রমিত বাংলা উচ্চারণ তত্ত্ব শেখাতে তাদের থিয়েটারকর্মী হিসেবে প্রস্তুত করবার প্রণালিগত অংশ হিসেবে। আরও পরে যখন আরও একটু শিক্ষিত হলাম বুঝলাম পরম্পরার চরম অপুষ্টি আর অসুরের অভিশাপগ্রস্ত এইসব শিশুদের মেধা ও মনন আধুনিক উৎকৃষ্টতর মানুষের নয়। রাষ্ট্র পিতা নয়। শিক্ষক ঈশ্বর নয়। চেষ্টায় সব হয় না সবসময়। 


যাই হোক, জোনাকি যেহেতু আমার সব স্বপ্ন পরিকল্পনা, প্রতীজ্ঞা ও উদ‍্যোগে পানি ঢেলে দিয়েছিল আমি ওর প্রতি সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। আর আমার মূল‍্যবান সময় ও বিশ্বাস নষ্ট করা এবং তারচেয়েও ভাইবোনদের কাছে আমাকে বিশ্রীরকম হাস‍্যকর করে তুলবার প্রতিশোধ হিসেবে আমি ওর চেহারা নাম অস্তিত্ব সব ভুলে যেতে চাইলাম এবং গেলামও। আমারি সাথে সাথে ও যে বড় হচ্ছিল খুব কাছেই আমার কোনো ধারনাই ছিল না। কখন যে ফ্রক ছেড়ে কামিজ পরতে শুরু করেছিল কিংবা মাথার গায়ের ধুলোগুলো ঝেড়ে ফেলতে আদৌ কোনোদিন শিখেছিল কি না তাও জানতাম না। পরে শুনেছিলাম ওর বিয়ে হয়েছিল বাচ্চাও হয়েছিল। আমি খুব নিমগ্ন ছিলাম আমার আপটাউন গন্ডীর সম্পর্ক শিহরণ বোধ আর চর্চাগুলো নিয়ে। বিভৎস মজায় দিনগুলো কাটাতে লাগলাম বন্ধুদের সাথে আর প্রগৈতিহাসিক সমাজ ও শিক্ষাব‍্যবস্থার প্রতি চুড়ান্ত অবজ্ঞা প্রদর্শন করে আমরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাটিয়ে দিতাম হুল্লোড়ে আর আকাশকুসুম স্বপ্নের ঘোরে। এরই মধ‍্যে আমি একটা প্রেম করতেও শুরু করলাম পুরোপুরি বেয়াড়া গোছের। এতোটাই বেয়াড়া হয়ে উঠেছিলাম যে বাড়িতে সবাই আমার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিল। এমন কি মনার মাকেও যদি বলতাম যে "বুয়া, একগ্লাস পানি দাও তো" সেও আমার দিকে চোখ গরম করে না জানি মনে মনে কত গালি দিতে দিতে পানি না দিয়েই গটগট করে চলে যেত। চেনাজানা বন্ধুরা ও পরিচিতরা মনে হতো যেন পপকর্ণ নিয়ে তামশা দেখতে বসেছে। তারা প্রকট আত্মবিশ্বাসেই বলে বেড়াতো যে এই মেয়ে হল এক হাড়বজ্জাত ফাজিল, প্রেমট্রেম কিচ্ছু না, নতুন কোনো বদমাইশির খেয়াল বা ফন্দি ছাড়া একে আর কিছুই বলা চলেনা। আরও বলতো যে ভাল মানুষ প্রেমিক বেচারার কপালে দূঃখ আছে। কিন্তু আমি সেই প্রেমিকটার সঙ্গে শব্দে গন্ধে চুম্বনে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। ওর অদ্ভুত সুন্দর মুখ আর একাগ্রতা আমাকে প্রতিনিয়ত দূর্বল আর কেমন যেন ভীতুও করে তুলতে লাগলো। এরই মধ‍্যে একদিন ডেটিংয়ে যাবার আগে বাবার কাছ থেকে জন্মদিনে উপহার পাওয়া আকাশনীল সুতোর কাজ করা মসলিনের জামাটা ইস্ত্রী করতে গিয়ে বুঝি ইচ্ছে করেই একেবারে বুক বরাবর পুড়িয়ে দিল মনার মা। আর আমি ক্ষেপে যেতেই কোনো কথা না বলে উল্টো রাগ দেখিয়ে চলে গেল অন‍্য ঘরে। আমার মাথায় এমন আগুন জ্বললো যে মনে মনে ঠিক করলাম এবার এই শয়তান মহিলাটাকে যে করে হোক তাড়াতেই হবে।


আমার মা ই ছিল পরিবারের সর্বেসর্বা। তার তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তা ও কঠোর পরিশ্রমের কারনে তো বটেই তাছাড়া নিজের সুদৃঢ় অবস্থান এবং অবিনাশযোগ‍্য ক্ষমতার ব‍্যাপারে তার ছিল অটুট সাবধানতা। ক্ষমতা ও পরম্পরা সংরক্ষণের বুনিয়াদি শিক্ষা সে পেয়েছিল তার নিজের মায়ের কাছ থেকেই যে ছিল এক কট্টর পাঠান। অপ্রতিদ্বন্দী সৌন্দর্য এবং সম্ভ্রান্ত জীবনযাপনের অহংকার তাদের দুজনেরই মোক্ষম অস্ত্র ছিল হালের প্রতিযোগীতামূলক সমাজ বাস্তবতায়।  মনার মা নিশ্চই এই সবকিছু নিয়েই মোহমুগ্ধ ছিল কারন  যাই হয়ে যাক না কেন সে প্রতিটি কাজে এমন দক্ষতা এবং সম্পুর্ণতার পরিচয় দিত যেন কোন প্রশ্ন কেউ না তুলতে পারে। কিন্তু তারপরও হঠাৎ কখনো কখনো সে তার মনের ভিন্ন চিন্তা প্রকাশ করে ফেলতো যেমন "বড় বাইয়ারে দেরী কইরা বিয়া দিয়েন", "ছোড বাইয়ারে ঠিক করেন", "ছোড আফাই সবচেয়ে সংসারী, দ‍্যাখবাইন ফরে"। এ সমস্তই ছিল সীমা অতিক্রম করা গায়ে জ্বালা ধরানো কথা। সে হোক, মনার মার মনা ছিল সে গাছে চড়তো আর পেড়ে দিত নিমপাতা, যেকোনো চামড়ার সমস‍্যার অব‍্যার্থ সমাধান। আরও পেড়ে দিত সজনে, সজনের পাতা, সজনের ছাল, মেহগনির গোটা, বড় গাছে লতিয়ে ওঠা ধুন্দল আর সোনালু ফুলের ঝাড়ও। সে হয়েছিল পুরো মায়ের মতো দেখতে আর খুবই ভদ্র স্বভাবের। কোথাও একফোটা দুর্নাম তার ছিলনা। কিছু কাজমাজও করতো পরিবারকে সাহায‍্য করতে। যে বছর মনার মায়েরা দেশে গেল বেড়াতে ফিরে এল মনার বউ শারমিনকে সাথে করে। আমরাতো দেখে অবাক অমন নায়িকার মত সুন্দর বউ দেখে। যেমন গায়ের রঙ তেমন লম্বা আর তেমনই চোখমুখের নকশা। মনার মা জানালো ও বেচারির মাবাবা নিজের ভাইবোন কেউ নেই, কোন এক আত্মীয়র কাছে থাকতো বড় অভাবে। যৌতুক তো নয়ই বরং সাধ‍্যমত নিজেই সাজিয়ে ছেলের বউ এনেছে সে। কিছুদিন পর শারমিনও কাজে যোগ দিল আমাদের বাড়ি আর বিনিময়ে পেল আউটহাউজে নিজের একটা আলাদা ঘর যেখানে সে মনার সাথে নতুন সংসার পেতেছিল। শারমিনের রুপ দিনদিন আরও খুললো, হাড্ডিসার দেহটায় একটু প্রাণ এলো আর কিছুদিনের মধ‍্যে বুঝলাম জীবন সম্পর্কে ওর একটা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি আছে আর একপ্রকার রসবোধও আছে। সে তার ভাগ‍্য নিয়ে বেশ সুখী ছিল কারন শ্বশুরবাড়ির সবাই তাকে ভালবাসতো, মনা তার সাথে ভাল ব‍্যবহার করতো আর সবচেয়ে বড় কথা সে পেটভরে খেতে পাচ্ছিল আর ভাল ভাল পরতেও পারছিল। 


এরই মধ‍্যেই জানিনা কি হলো একদিন মা খুব ক্ষেপে উঠলো মনার মায়ের ওপর আর সিদ্ধান্ত নিল সেই মুহূর্তেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ওদের আউটহাউজ থেকে বের করে দেবে। এই চরিত্রহীন মহিলা আর তার নেশাখোর স্বামীটিকে এতদিন সহ‍্য করাটা এক ক্ষমার অযোগ‍্য পাপই মনে হলো তার। আমার বোন ততোদিনে খুবই ধার্মিক হয়ে উঠেছে আর একজন ধার্মিক স্বামীও পেয়ে গিয়েছিল সেই সাথে ছিল সাত মাসের অন্তঃসত্তা। সামনে তার চতুর্থবর্ষের চুড়ান্ত পরীক্ষা, এই শারীরিক ও মানসিক অবস্থার মধ‍্যেও সে ক্ষেপে উঠলো ওই দূষিত পরিবারটাকে উচ্ছেদ করতে। আর আমিও সুযোগ পেয়ে কিছু না বুঝেই গলা তুল্লাম "দাও দাও এক্ষুনি বের করে দাও।" বাবা শুধু বললো "ছেড়ে দাও না। এতো বছরের পুরোনো লোক। কি আছে? বাদ দাও।" এমন দূঃশ্চরিত্রদের প্রতি এমন মহানুভবতা দেখে মা যেন আরও ক্ষেপে উঠলো। আর আমরা সবাই ই মতামত দিলাম ওদের বের করে দেয়া হোক। আমরা কেউই ভাবলামই না যে ওরা কোথায় যাবে আর এতোগুলো বছর তো মানুষটা ছিল, তার সমস্ত অস্তিত্ব ও স্বয়ংক্রিয়তা নিয়ে এখানেই ছিল। আমরা যখন প্রবল ক্ষয়ের মধ‍্যে বেড়ে উঠছিলাম আর এক এক করে স্বপ্নগুলোর সাথে সাথে মর্যাদাও হারাচ্ছিলাম, বন্ধুরা যখন তাদের হৃদয়ের রঙ দেখাচ্ছিল আর অন‍্য দেশে অন‍্য শহরে অন‍্য বন্ধনে পাড়ি দিচ্ছিল, বাবার বদলিটা যখন আর ঠেকানো গেলনা আর স্নেহহীন শহরে অস্তিত্বের লড়াইটা একলা একলা লড়তে লড়তে যখন আমি একটু একটু করে উচ্ছন্নে যাচ্ছিলাম আর যখন দিনের পর দিন পাহাড়ের অনেক অনেক ভেতরে যেখানে লোকের আনাগোনা নেই মোটেও সেখানে  গিয়ে বসে থাকতাম সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত, একলা, আলাভোলা বোনটা যখন তার হাতের অনামিকা থেকে আংটিটা খুলে ছুঁড়ে ফেলেছিল ঘাসের ওপর জাম গাছটার নিচে ভেউভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে আর তারপর জীবনটাকে কিছুতেই গোছাতে পারছিল না, ভাইটার যখন আদর্শ বদলে যাচ্ছিল, সে তো এখানেই ছিল। আবার যখন ক্লাবে বৈশাখী উৎসব করতাম সোসাইটির সবাই মিলে কিংবা শহীদ দিবস স্বাধীনতা দিবসে মরমী শোকের গান দেশের গান গাইতাম, তখনো  সে তো ঠিক দেখতে চলে যেতো। একদিন ভোরবেলায় যখন বোন চিৎকার করে করে বাড়ি মাথায় তুলেছিল আমাদেরই এক কামুক আশ্রিত পশু আর তেরো বছরের রুবিয়াকে বাথরুমে দেখতে পেয়ে, যে রুবিয়া ছিল বয়সে আমারই সমান আর ওই কাজের মেয়েটাকে আমি একটুও পছন্দ করতাম না কারন তার ফর্সা রঙ নিয়ে খুব গর্ব ছিল আর সে ভাবতো আমার পুরোনো জামাগুলো ওকেই বেশি মানায়, সেদিনও মনার মা ছুটে এসেছিল। ছোট শাওন যে অবাক হয়ে ভাবতো আর বিকেলে খেলতে গেলে বলতো "তুমিই কি কাল গান গাইছিলে" কিংবা "তুমি কি এখন একটা গান করবে?" সেই ছোট শাওন যখন কিছু বছর পর পর্ণ আসক্ত হয়ে গেল আর কেমন করে যেন তাকাতো আর মাঝে মাঝে একলা ঘরে কলগার্লদের ডাকতো, পিপুটা যখন বাড়ি ছেড়ে পালালো আর ফিরে এলো আলখাল্লা আর পাগড়ি পরে বলছিল "এ জীবন মিথ‍্যে", "পৃথিবীটা কারাগার", "বাড়িটা একটা নরক", "মাটার মাথা খারাপ", "বোনটা কুলাঙ্গার", "বাবাটা একটা পিশাচ" আর তারপর একদিন আবারো পালিয়েছিল, পিপুর বাবাটাই তো বিকেলে সামনের রাস্তায় আধঘন্টা ধরে হাঁটতো আর রেগে রেগে আমাদের বাড়ির দিকে আর আমাদের দিকে তাকাতো, কে জানে বাবার সাথে ওর কি ঝামেলা ছিল, সূচীতো আমারই সমান ছিল পুতুলের মত দেখতে আর সবচেয়ে ভাল গান গাইতো, ওর ব্রেইন ক‍্যানসারের খবরটাতো মনার মাই প্রথম দিয়েছিল। আর অরণী আপু যে কবে এমন গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল আমরা তো জানতামই না। প্রতিদিন ওর বাবা ওর হাত ধরে হেঁটে হেঁটে এসে সোনালু গাছগুলোর নিচে এসে বসতো। প্রতিদিন। আর একটা কথাও বলতোনা দুজনে। মনার মা খুব দূঃখ করতো ওর জন‍্য। সব খবর মনার মায়ের কাছে ছিল কোন বাড়িতে ম‍্যাডাম মার খায় কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয়না, কার ছেলে নেশা করে, কাদের কাজের মেয়েটা ঠিক করেছে যে সে এখন থেকে নগ্নই থাকবে, কার বিয়েতে কতো যৌতুক, কাদের বাড়িতে ডাকাতরা গতরাতে পুরো দুই কোটি টাকা নগদ আর চল্লিশ ভরি সোনা নিয়ে গেলেও ওরা থানায় জিডি পর্যন্ত করছে না। সব সব সব খবর।


বাধ সেধেছিল মনার মা। সে কাজে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল আর শারমিনকেও কাজে আসতে দিচ্ছিল না। আর সাফ সাফ জানিয়েছিল যে যুতসই কাজ এবং ঘর না পেলে তারা যাবেনা আর তা অন্তত দু'তিন মাস তো লাগবেই। আমাদের মনে তিক্ততা আরও খিঁচড়ে উঠেছিল এসব শুনে। কিন্তু এরমধ‍্যে এলো মহাবিপদ। বাবার অফিসে কি এক অনুসন্ধানী চিঠি এলো আর পুরো শহরটা যেন নড়ে উঠলো। অতদিনে কিছু শেয়ালেরা দল বেঁধে একটা কাজের মতো কাজ করতে পেরেছিল। অভিযোগ উঠলো আমার বাবা ও তার পদস্থনরা মিলে না কি পুরো ছয়শো কোটি টাকা আত্মসাত  করেছে। অনুসন্ধানকারীরা এলো, সাংবাদিকরা এলো, নেতারা এলো, আরও কতজন যে এলো, তারপর পত্রিকায় খবর বেরুলো, টিভিতে প্রতিবেদন দেখালো। আমার বাবাটা, ভয়ংকর লোভী কুৎসিত শকুনে ভরা আমলাতন্ত্রের মধ‍্যে যে সারাজীবন সৎ থেকেছে, আর সারাজীবন এক অন্তহীন অনন‍্য সংগ্রাম করে গেছে, সে পুরো ঘটনাটার আকস্মিকতায় দিশাহারা হয়ে পড়লো এবং অত‍্যন্ত সুকৌশলী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে এক অভেদ‍্য পৈশাচিক চক্রব‍্যুহে আটকে পড়লো। ওর বায়ান্ন বছরের যুদ্ধটা যখন প্রায় শেষ করে আনছিল তখন ওরা যেন ওকে নিলডাউন করে বসিয়ে ওর সমস্ত নীতি আদর্শ আর পরিশ্রমকে পা দিয়ে পীষছিল আর ওর গায়ে মিথ‍্যার থুতু ছিটাচ্ছিল।


বাবা সহ‍্য করতে পারেন নি ওই অপমানটা, অফিসেই প্রথম হার্ট এ‍্যাটাকটা হয়েছিল। আমার বোনও অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। বাবা আইসিইউতে ছিল আর বোনটাকেও ভর্তি করা হয়েছিল ক্লিনিকে। আমি একা একা বাড়িতে, মাথাটা কাজ করছিল না একদম, কাঁন্নাও পাচ্ছিল না। বাড়িতে সাহায্য করতে শুধু রুমা আসতো, সে আবার আট মাসের পোয়াতি। মনার মা, মনার বাপ, জোনাকী, মনা কিংবা শারমিন কেউ একটা খবর নিতেও এলো না। আমি শুধু সারাদিন যেন এক অশরীরির মতো রান্না করতাম আর হাসপাতালে খাবার পাঠাতাম। দুদিন পর বাবার অবস্থার উন্নতি হলে ওকে রেগুলার বেডে দিয়েছিল আর একই দিনে বোনের ছেলেটা জন্মালো। অফিসের সহকর্মীরা এসে সাহস যোগাচ্ছিল আর বলছিল আস্থা রাখতে সত‍্যের ওপর। সবকিছুর মধ‍্যেও বোনের প্রিম‍্যাচুর্ড পুতুলের মত ছানাটা আর প্রকৃত সত‍্যের প্রতি বিশ্বাস আমাদের একটু হলেও সাহস যুগিয়েছিল। আমরা শুধু ভেবেছিলাম বাবা আর ছানাটাকে যে করে হোক বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সেদিন সকালে হাসপাতাল থেকে ফিরে একটু ঘুমাতে পেরেছিলাম যেন কত কত বছর পর। দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে আবার ছুটে ছুটে গিয়েছিলাম রান্নাঘরে কারন রাজ‍্যের কাজ বাকি। দরজাটা খুলে নিচে চোখ পড়তেই চমকে দেখি মনার মা ওর ঘরের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ওপরে বাড়িটার দিকে কিংবা হয়তো ঠিক আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। সেই খেটে খাওয়া শরীর ফুলের নকশার ছাপা শাড়ি আঁটসাঁট খোঁপা আর ওর চোখে যেন আগুন ঝরে পড়ছিল। প্রখর সূর্য উপেক্ষা করে ও যেন স্থির আগুনে চোখে দাবী করছিল ওর অধিকার। বাসস্থানের অধিকার, খাবারের অধিকার, বাঁচার অধিকার, সমাজের অর্থনীতির তলানিটুকুর অধিকার, মর্যাদার অধিকার, এমন কি লাম্পট‍্যেরও অধিকার। আমি কেমন ভয় পেয়ে উঠেছিলাম আর অস্ফুটে আর্তনাদ করে দ্রুত দরজা থেকে সরে এসে মুখে হাত চেপে মেঝেতে বসে পড়েছিলাম। চোখের সামনে যেন দেখছিলাম দিনে দিনে আমার নিজের ভেতরেই তৈরী হওয়া আঠারো বছরের দম্ভ আর অবজ্ঞার অট্টালিকাতে কি গভীর ফাটল ছড়িয়ে পড়ছে।

(ক্রমশ...)



No comments:

Post a Comment

English Translation of Bangla Folk Song: Fakir Lalon Shah; চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি; Forever I Nurtured a Mysterious Bird

 Forever I Nurtured a Mysterious Bird Forever I nurtured a mysterious bird, which never discloses its identity. For this grief, my eyes ...