Sunday, July 31, 2022

টুকরো কথা : শিল্পবিশ্বাস

কিছু কিছু যুক্তি শুধুমাত্র খোঁড়া নয়, খুব হাস‍্যকরও। অনেক বিদগ্ধ লোকজনকে দেখছি বলছেন রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় শিল্পকর্মের কপিরাইট যেহেতু শেষ হয়ে গেছে সেহেতু রবীন্দ্রনাথের গান যে কেউ যেমন খুশি তেমনভাবে গাইতে পারবে, বাজাতে পারবে। 

রবীন্দ্রনাথ একজন মহান ধ্রুপদ পন্ডিত ছিলেন। শোনা যায় অত‍্যন্ত দক্ষ কন্ঠশিল্পী ছিলেন এবং একাধিক বাদ‍্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন। ছিলেন অসামান‍্য গিতিকার এবং সুরকার। তাঁর লেখা ও সুর করা গানগুলোর বেশিরভাগেরই পরিচ্ছন্ন, সুনির্দিষ্ট স্বরলিপি  তৈরী করা হয়েছে এবং ছাপা হয়েছে, এটা এই গোটা ভারতবর্ষের সৌভাগ‍্য। নইলে এতোদিনে বহুলোক রবিঠাকুরের অসংখ‍্য গানই নিজের নামে চালিয়ে দিত, মৌলিক সুর বদলে দিত, কথাও পাল্টে দিত। যেটা অত‍্যন্ত প্রকটভাবে অন‍্য ধারার সংগীতে, বিশেষ করে লোকসংগীতে দেখা যায়। এবং যার ফলে বহু লোকজ সংগীতের সুরসংগঠন, বাণী, ভাব ও মূল দর্শনও বিকৃত হয়েছে, এমন কি বহু অমূল‍্য সৃষ্টি বিলুপ্ত হয়েছে।

কপিরাইট একজন সৃ‍‍ষ্টিশীল মানুষকে এবং তার উত্তরাধিকারদের একটা মেয়াদ পর্যন্ত মৌলিক সৃষ্টির বিপরীতে স্বত্বাধীকার প্রদাণ করে শুধু, যার ফলে বাজারজাতকৃত সৃষ্টিশীল কাজ থেকে আয় করা অর্থ থেকে মূল সৃ‍ষ্টিকর্তা ও তার পরিবার একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বঞ্চিত না হয়। কিন্তু মৌলিক শিল্পকর্ম পরিবর্তন করার অধিকার কখনো কি কেউ পেতে পারে, যখন সেই মৌলিক শিল্পকর্মটি চোখের সামনে আমরা দেখতে পাচ্ছি কিংবা সেটি নথিভুক্ত। ভাবুন তো কেউ অপরাজেয় বাংলা ভাষ্কর্যের মানবমুখমন্ডলগুলোর নাকগুলো ভেঙ্গে দিলো একদিন আর বললো "আমি ইমপ্রোভাইজ করলাম"। কিংবা কেউ বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের দপ্তর বইটি ছাপিয়ে দিল এর সংলাপগুলো পাল্টে দিয়ে।

ইম্প্রোভাইজেশান, এক্সপেরিমেন্ট এবং বিকৃতি এক কথা নয়। আমাদের বিদগ্ধ শিল্পসচেতনেরা কেন সবকিছু গুলিয়ে ফেলছেন তা আমার ধারনার বাইরে। সম্ভবত সাধারণ বুদ্ধি তাদের নেই কিংবা আমি একজন নিতান্তই আহাম্মক। 

আমাদের ভারতবর্ষে বহুকাল আগ থেকেই শিল্পের মৌলিকতা ও নিজস্বতাকে স্বিকার করা হতো। তা যদি না হতো, মূল স্রষ্টা বিস্মৃত হয়ে যাবার পরও খেয়াল অঙ্গের রাগসংগীত শেখানো এবং পরিবেশন করবার সময় তার সুরগত চলনের মূল সংগঠন ও তাল-লয় কেউ থোড়াই কেয়ার করতো। আদৌ কেউ দশটা ঠাঁট মেনে নিত কিংবা অসংখ‍্য রাগরাগিনীর আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য মেনে নিত। ইম্প্রোভাইজেশান এবং এক্সপেরিমেন্টের চুড়ান্ত পর্যায়ের উদাহরণও হলো এই রাগ সংগীতই। যেমন ধরুন ভৈরবী একটি অত‍্যন্ত সুগভীর ভক্তি ও প্রেমভাব পূর্ণ রাগ। এতে ঋষভ, গান্ধার, ধৈবত এবং নিখাদের কোমল স্বর ব‍্যবহৃত হয়। সংগীতের ব‍্যাকরণে তাই লেখা থাকে, বলা হয়ে থাকে। কিন্তু কোন দক্ষ কন্ঠশিল্পীকে হয়তো দেখা যাবে কখনো কখনো অবরহের সময় কোমল ঋষভের পরিবর্তে শুদ্ধ ঋষভ গাইলেন। এবং তাতে করে ভৈরবীর ভাব ক্ষুন্ন তো হলোই না বরং আরো প্রগাঢ় হলো। একে সংগীতের ভাষায় ইম্প্রোভাইজেশান বলা যেতে পারে। আবার ধরুন কোন একটা প্রচলিত বাংলা লোকগানের মৌলিক সুর অক্ষুন্ন রেখে তার সাথে ভিন্ন ভিন্ন রকম হারমনি সংযোজন করা হলো বা তালের সংগঠন দক্ষতার সাথে পরিবর্তন করে কেউ দেখলো আসলে ঠিক কেমন শোনায়। এই কাজটাকে এক্সপেরিমেন্ট বলা যেতে পারে। বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিকভাবে তুলনামূলক অপরিচিত এ‍্যাকোস্টিক বা সিনথেটিক টোন/ভয়েস বা রিদম প‍্যাটার্ন ব‍্যাবহার করে যে ফিউশান করা হয় সেগুলোকেও এক্সপেরিমান্টাল ওয়ার্ক বলা যায়। সংগীতে ইম্প্রোভাইজেশান কিংবা এক্সপেরিমেন্ট কোনটাই সংগীত বিষয়ে অজ্ঞদের কাজ নয় বরং যারা সংগীতে অত‍্যন্ত পারদর্শী তাদের জন‍্যই। সেই কারনেই পীযুষ কান্তি সরকার কিংবা সূচিত্রা মিত্রের মতো গুণীরা ছিলেন বলে রবীন্দ্রসংগীত আরো সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু মূল স্বরলীপিকেই যদি কেউ অস্বিকার করে, অজ্ঞ হয়েও ইম্প্রোভাইজেশান ও এক্সপেরিমেন্টের নামে এর মূল সংগীত গঠনকে যাচ্ছে তাই ভাবে বিকৃত করে তবে তা সেই সংগীতের সৃষ্টিকর্তাকেই অবমাননা করা হয়, অপমান করা হয়। বাখ এর কোন কম্পোজিশান যদি কেউ বিকৃত করে তবে তাকে বিকৃতিই বলা হয়। বাখ কিংবা বিদোভেন এর সংগীতকে ক্লাসিক সংগীত   স্বিকৃতি দেয়া হয় সারা বিশ্বে, রবীন্দ্রসংগীতকে ক্লাসিক হিসেবে মেনে নিতে আপত্তি কেন এই বাংলাদেশে? 

এমনটাও নয় যে গাইতে পারে না সে গান গাইতে পারবে না। মানুষ মনের আনন্দে গান গাইবে এটাই কাম‍্য ও সুন্দরতম বিষয়। কিন্তু কেউ যদি নিজেকে সংগীত শিল্পী দাবী করতে চায় এবং সংগীতকে পেশা হিসেবে নিতে চায় তবে এই শিল্পটি তাকে শিখতে তো হবে, অন‍্য আর সব শিল্পের মতোই। অবশ‍্য যুগের হাওয়া এখন অন‍্যরকম, সংগীত শিল্পীদের পরিবেশনা আজকাল বাংলাদেশের লোকজনের আর ভালো লাগে না, সুদক্ষ শিল্পীদেরটা তো আরো না। বরং অশিল্পীদের গান শুনতেই তাদের ভালো লাগে। কোটি কোটি মানুষ বিকৃতরুচির স্থুল পরিবেশনাগুলোকেই সমর্থন করে ও ভাইরাল করে তোলে। হয়তোবা বেশিরভাগই নিজের অজান্তেই কিন্তু এই যুগে এই অজ্ঞানতা ক্ষমাহীন, তা নিজেকে শেষ করারই সামিল। বিশেষ করে যখন এক সুসংগঠিত কুচক্র প্রতিনিয়তই চায় বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের মানুষকে হেয় করতে। তারা প্রমাণ করতে চায় বাংলাদেশ অশিক্ষিত, কুরুচিপূর্ণ, শিল্পহীণ, সৌন্দর্যবোধহীন, স্থুল  মানুষদের দেশ। নিজের অজান্তে আমরা যদি এই কুচক্রের হয়েই কাজ করি তবে এই উদাসীনতা, বিবেচনাহীনতা ক্ষমাহীন।

অনেক বাড়িতেই বাবা মায়েরা ও পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা বাচ্চাদের দেশবিদেশের সমৃদ্ধ ক্লাসিক সংগীত শোনাতেন আগে। সমসাময়িক সংগীতও শোনাতেন কিন্তু খেয়াল রাখতেন তার যেন মান ভালো হয়। যার যার সামর্থের মধ‍্যেই সেরা সংগীতটিই বাচ্চাদের শোনাতে চেষ্টা করতেন তারা। তাদের লক্ষ‍্য থাকতো বাচ্চাগুলো শিল্প সংস্কৃতির সাথে যেন পরিচিত হয় এবং বেসুরো হলেও কোনভাবেই যেন অসুরপ্রেমী না হয়।  বই, সিনেমা, এইসবের বেলাতেও তাই। এখনো হয়তো বাবা মায়েরা এভাবেই ভাবেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে যে তাদের রুচিবিকৃতি ঘটেছে ও সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পেয়েছে তা হয়তো অনেকেই জানেন না। শিল্পসংস্কৃতির সাথে সবচেয়ে নিকটতম সম্পর্ক হলো সৌন্দর্যের। কেউ হয়তো বলতে পারেন শিল্প তো কুৎসিতও হতে পারে। কিন্তু ভেবে দেখুন তো সমাজ ও ব‍্যাক্তির কুৎসিত রুপকে নান্দনিক বিভৎসতার সাথে ফুটিয়ে তুলতে শিল্প ছাড়া আর কিছু কি পারে? এটাই শিল্পের বিমূর্ত সৌন্দর্য। এ টাকা থাকলেই কিনতে পাওয়া যায় না, গুলে খেয়েও নেয়া যায় না। একে চর্চা করতে হয়, লালন করতে হয়, এর স্বার্থহীণ অমরতাকে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস করতে হয়। 




No comments:

Post a Comment

English Translation of Bangla Folk Song: Fakir Lalon Shah; চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি; Forever I Nurtured a Mysterious Bird

 Forever I Nurtured a Mysterious Bird Forever I nurtured a mysterious bird, which never discloses its identity. For this grief, my eyes ...