আমার বাবাকে ছয়শো কোটি টাকার একটা দূর্নীতি মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছিল। সে সময় কোন প্রমাণ ছাড়াই শুধুমাত্র একটা অনুমানের ভিত্তিতে পত্রিকায় এবং টেলিভিশনের খবরে আমার বাবার নাম অভিযুক্ত দূর্নীতিবাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট ডিভিশানের হেড হিসেবে, সারা জীবন সৎ থাকা আমার বাবা, যদি ওই একটি মাত্র দূর্নীতি করে ওই ছয়শো কোটি টাকার ন্যুনতম দশ শতাংশও আত্মসাৎ করতো তবে সে খুব সহজেই পুরো ক্যাশ ষাট কোটি টাকার মালিক হয়ে যেতো। সেই ষাট কোটি টাকার বর্তমান মূল্য হয়তো দাঁড়াতো অন্তত দুইশো কোটি টাকা, ক্যাশ। আমার বাবা সারা জীবন কর্মক্ষেত্রে সৎ থেকেছেন। অনেকেই থাকেন। আমার নিজের পরিবারেই বেশ ক'জন কয়েক প্রজন্মের সরকারি কর্মকর্তাদের খুব কাছ থেকেই সৎ থাকতে দেখেছি, এখনো দেখছি। আমার বাবার বিশ্বাস ছিল পৃথিবীতে সৎ ও ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি, বলতো যেন কখনো বিশ্বাস না হারাই মানুষের ওপর। শেষ পর্যন্ত বাবার সেই বিশ্বাস অটুট ছিল কি না সে ব্যাপারে আমি দ্বিধাগ্রস্ত বোধ করি মাঝে মাঝে। আমার বাবা একটা প্রচন্ড হতাশা ও কষ্ট বুকে নিয়েই তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল হয়তো। কারন সেই দূর্নীতি মামলাটার কোনদিন নিষ্পত্তি হয়নি এবং কোন প্রমাণ না মিললেও বাবাকে তার জীবদ্দশায় ওই মামলা থেকে নিষ্কৃতি দেয়া হয়নি। বরং মামলা চালাতে গিয়ে এবং দূর্নীতিবাজ প্রশাসনিক অনুসন্ধানকারীদের মিথ্যা রিপোর্টিংয়ের ব্ল্যাকমেইলিংয়ের চক্করে পড়ে তার শেষ সম্বল ও শান্তিটুকুও খুইয়ে ফেলেছিল। এছাড়াও মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় চাকরি শেষে পাওনা ফাইনাল স্যাটেলমেন্টের টাকাটাও দেখে যেতে পারেনি বাবা। একবার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এই পুরো ঘটনাটা সে ঠিক কিভাবে দেখে? বাবা উত্তর দিয়েছিল "এতো মানুষ অন্যায়ের শিকার হচ্ছে, এতো মানুষ বিচার পাচ্ছেনা, আমিই বা কেন বাদ পড়বো? অন্য অনেকের সাথে যা হচ্ছে এই সময়ে, আমার সাথেও তাই হচ্ছে।" আরো জিজ্ঞেস করেছিলাম সারা জীবন সৎ থেকে, এতো মানুষের জন্য এতো ত্যাগ করে কি পেলে? কিছুই তো পেলে না জীবনে, কি লাভ হলো? বাবা এসব প্রশ্নে মৃদু হাসতো শুধু, বলতো, "এভাবে বলে না মা। কে বললো আমি জীবনে কিছু পাই নাই? আমি জীবনে অনেক কিছু পেয়েছি। এতো কিছু, যা কোনদিন চিন্তাও করি নাই, আমি যা পেয়েছি মানুষ তো কল্পনাতেও তা পায়না। এর জন্য আমি আল্লার কাছে শুকরিয়া আদায় করি। আমার মতো সামান্য মানুষের প্রতি উনার এতো দয়া। একটা কথা মনে রাখবা মা তোমার জীবনের হিসাব কখনো অন্য মানুষকে করতে দিবানা। তুমি কি পেয়েছো কি পাও নাই জীবনের কাছ থেকে তা শুধু তুমিই জানো আর আল্লা জানেন।"
আমার বাবাকে কখনো অযথা উঁচু গলায় কথা বলতে শুনিনি। কখোনো প্রতিবাদ করতে দেখেছি কিংবা নিজের মতামত প্রকাশ করতে দেখেছি, কিন্তু কারো সাথে খারাপ ব্যাবহার করতে বা অপমান করতে দেখিনি। আমার মা বা অন্য কোন নারীর মর্যাদা ও যোগ্যতাকে অসম বিচার করতে দেখিনি। মায়ের কোন চিন্তা বা সিদ্ধান্তকে অসম্মান করতে দেখিনি। সন্তানদের মধ্যে বিভেদ করতে দেখিনি। কোন ধর্মের বা বিশ্বাসের মানুষের প্রতি বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করতে শুনিনি। একজন বাবা হিসেবে এবং প্রয়োজনে একজন মায়ের মতোও বুকে রেখে লালনপালন করেছেন আমাদের। এতো স্নেহ দিয়েছেন যা আমৃত্যু আমাদের আগলে রাখতে পারে। এমন জীবন বোধ জাগিয়ে দিয়ে গেছেন নইলে এই দূবৃত্ত সময়ে বেঁচে থাকা হয়তো কঠিন হয়ে যেত। বাবা আমাদের শিখিয়েছেন কিভাবে অল্পতে সন্তুষ্ট থাকতে হয় কারন অসংখ্য মানুষের ওই অল্পটুকুও নেই। শিখিয়েছেন "যদি তোমার ইচ্ছা থাকে তুমি তোমার অল্পটুকুই, যার তাও নেই তার সাথে ভাগ করে নিতে পারো। তোমার অল্প সম্বল নিয়ে নিজে তো ভালো থাকতে পারোই অন্যের পাশেও দাঁড়াতে পারো। এর পুরোটাই নির্ভর করে তোমার ইচ্ছা ও পছন্দের ওপর।" বাবা কথায় ও কাজে এক ছিল। কম কথাই বলতো বাবা কিন্তু যা বলতো তার প্রতিফলন আমরা ওর জীবনযাপন ও কাজে দেখতে পেতাম। মনে আছে আমাদের বাসায় সবসময় কয়েকজন লোকের জন্য বাড়তি রান্না করা হতো। সরকারি দপ্তরে সারা দেশ থেকে লোক আসতো কাজে। কতো বৃদ্ধবৃদ্ধারা, দরিদ্র লোকেরা কাজ নিয়ে আসতো, বাবা প্রয়োজনে অতিরিক্ত সময় কাজ করে ওদের ঝামেলা ও খরচ কমানোর চেষ্টা করতো আর যাদের খাবার পয়সা নেই তাদের খাওয়ানোর জন্য ঘরে নিয়ে আসতো সাথে করে। আমার মাকেও কখনো এ নিয়ে কোন অভিযোগ করতে শুনিনি। বাবার চেনা কেউ অর্থসঙ্কটে পড়লে সবার আগে ওদের মোহাম্মদের (বাবার) কথাই মনে পড়তো, নিজের পকেটে টাকা না থাকলেও, বাবা যদি বলতো অন্য লোকেরা অচেনা মানুষকেও ধার দিতে রাজী হয়ে যেতো।
আমার বাবা কর্মজীবনে, পারিবারিক জীবনে এবং সামাজিক জীবনেও অত্যন্ত সফল একজন মানুষ ছিল। অনেকে আবেগপ্রবণ হয়ে ওকে আল্লার ফেরেশতাও বলতো। শেষ কয়েক বছর বলতে গেলে একদম বাসা থেকে বের হতো না বাবা। মাঝে মাঝে দরকারে অফিসে বা মেডিকেল চেকাপে গেলে লোকজন খবর পেয়ে ছুটে ছুটে আসতো এক নজর দেখার জন্য, একটু কথা বলার জন্য। দূর্নীতির দায়ে ফাঁসিয়ে দেবার পরও লোকজন ভীড় করে সাহস যোগাতো বাবাকে বলতো "একদম ভয় পাবেন না স্যার/ভাই, আমরা বিশ্বাস করি আপনি কোন অন্যায় করেন নি। সব ষড়যন্ত্র। আপনার কেউ কোন কিছু করতে পারবেনা।" লোকজনের আবেগ উৎকন্ঠা দেখেও বাবা লজ্জিত বোধ করতো। ভাবতো ওর জন্য অন্যদের শান্তি নষ্ট হচ্ছে। বাবা কাউকে কষ্টে ফেলতে চাইতো না। প্রচন্ড অসুস্থ অবস্থাতেও কেউ সামান্য সাহায্য করে দিলে খুব লজ্জিত বোধ করতো। মৃত্যুর সময় নিজের গায়ের ফুলশার্ট আর গেঞ্জি নিজে খুলে ফেলেছিল যেন মৃত অবস্থায় অন্যদের কোন কষ্টে না পড়তে হয়। বাবা মারা যাবার পর যারা এসেছিল ওরা সবাই বলেছিল "একজন মানুষ চলে গেল আমাদের ছেড়ে। এমন মানুষ আর কি জন্মাবে?" কেউ বা বলেছিল "উনি ফেরেশতা ছিলেন। মানুষের শরীর দিয়ে আল্লা উনাকে পাঠিয়েছিলেন।" মানুষের কথা শুনে সেদিন মনে হয়েছিল সত্যিই তো, মানুষ হয়ে জন্ম নিয়ে এর চেয়ে বেশি আর কিইবা পাওয়ার থাকতে পারে এক জন্মে? বাবা ঠিকই বলেছিল, সে জীবনে অনেক কিছু পেয়েছে। এতো কিছু যা কেউ কল্পনাতেও পায় না।
ক্রমশ...
No comments:
Post a Comment