আমি হয়তো এই বাংলাদেশে এবং হয়তো এই ভারতবর্ষেও সেইসব ভাগ্যবতীদের মধ্যে একজন যাদের স্বামীরা তাদের ধরে ঠ্যাঙ্গায় না, কথায় কথায় গালমন্দ করে না, আঘাত দিয়ে ছোট করে কথা বলে না কিংবা উত্তমমধ্যম দেয় না। এই অশিক্ষিত বর্বর জনপদে এরকম বৈবাহিক জীবন ভাগ্যবতীদের কপালেই জোটে কিন্তু। আমার এক বন্ধু বহুদিন ধরেই স্বামীর নির্যাতন ভোগ করছিল। ওর স্বামী ওকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন তো করতোই, ওর প্রায় সমস্ত টাকা পয়সাও হাতিয়ে নিয়েছিল। তার ওপর লোকটার ছিল বহূ নারীর সাথে সম্পর্ক ও প্রবল মাদকাসক্তি। কোন ভরনপোষন তো দূর সে আমার বন্ধুটিকে বিন্দুমাত্র সম্মান পর্যন্ত করতো না এবং তার পরিবারও বেচারির এই দূর্ভোগ শেষ করার ব্যাপারে কোন পদক্ষেপই নিচ্ছিল না বরং বাড়ির বউয়ের দোষ খুঁজে বেড়ানোতেই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতো। আমরা কিছু বন্ধুরা ওর মুখে এমন করুন নির্যাতনমূলক বৈবাহিক জীবনের বৃত্তান্ত শুনে সবসময়ই কষ্ট পেতাম। বহূবার ওকে আইনি আশ্রয় নিতে এবং এই অসহ্য সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে অনুরোধও করেছিলাম। কিন্তূ আমার বন্ধুটির একটি বক্তব্যই ছিল যে সবকিছুর পরও সে তার স্বামীকে ভালোবাসে এবং তার সাথেই জীবন কাটাতে চায়। আমরা জানতাম সে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল এবং বেঁচে থাকার জন্য স্বামীর অর্থ তার প্রয়োজন নেই তবু ওর একগুঁয়ে ভালোবাসার কথা বুঝতে পেরে আমি ব্যাক্তিগতভাবে কখনো কখনো চেষ্টাও করেছি (অন্য বন্ধুরাও করেছে যে যতোটা পেরেছে) ওকে সময় দিতে, সাহস দিতে, ওর মন ভালো রাখতে এবং কোন একটা কাজে ব্যস্ত থাকতে সাহায্য করতে। বেশ কিছু বছর আগে একবার ওর স্বামী প্রবরটি ফোন করে একরকম আমাকে হুমকিই দিয়েছিল কারন আমি আমার বন্ধুটির জন্য একটা চাকরির চেষ্টা করছিলাম। পরে অবশ্য হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম কারন বন্ধুটি জানিয়েছিল তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির অমতে গিয়ে সে কোন কাজই করবেনা বলে ঠিক করেছে। সে যাকগে, বন্ধুটির এমন অটুট ভালোবাসা দেখে আমার সবসময় অবাকই লাগতো। তা সেই বন্ধু একদিন আড্ডা দিতে আসতে কিছু দেরী হওয়াতে ক্ষোভের সাথে জানালো "জামাইকে সবজি সিদ্ধ করে দিয়ে আসলাম। জানোনা তো ওকে সব রেডি করে দিতে হয়।" জানালো ওর স্বামী এখন ডায়েটিং এ আছে। লাঞ্চে শুধু একবাটি সবজি সেদ্ধই খায়। তা বেশ ভালো কথা তবে শুনে একটু খটকাই লাগলো। আমরা বাঙালি মেয়েরা তো শুধু স্বামী সন্তান নয়, আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব সবার জন্যই ভালবেসে নানান পদ রান্না করি এবং যত্ন করে খাওয়াই। পরিবারের লোকেদের প্রিয়জনদের পাতে নিজের হাতে রান্না করে চর্বচষ্য তুলে দিতে না পারলে একরকম মনোকষ্টেও ভুগি। পুরুষরাও কেউ কেউ আজকাল চেষ্টা করছে রান্নাবান্না করার কিংবা তা না পারলেও পরিবারে তাদের অবদান তো কম নয়। এই কঠিন অর্থনীতি ও কর্মসংস্কৃতির দেশে পরিবারের সব খরচের যোগান আমরা পুরুষের কাছেই আশা করি এখনও। পকেটে টাকা না থাকলেও আশা করি ধার করে হলেও ওরা দামি উপহার তুলে দেবে স্ত্রী সন্তান পরিবার পরিজনের হাতে। সেখানে স্বামীকে সামান্য একবাটি সবজি সেদ্ধ করে দিয়ে এতো ক্ষোভ! এ কেমন ভালোবাসা? আর যদি সম্পর্কে এতোই তিক্ততা জমে থাকে তবে শহরের একজন আধুনিক স্বাবলম্বি নারী কেন একটি সম্পর্ক বয়ে বেড়াবে? সে যাই হোক, একেকটা সম্পর্ক একেক রকম হয়, কারো ব্যাক্তিগত বোঝাপড়া আমার খাটো নাকের এখতিয়ারের বাইরে, তাই সেদিন ওকে কোন প্রশ্নও করিনি। তবে এর মধ্যে একটা মজার ঘটনা ঘটলো, এই বন্ধুটিই একদিন বলে বসলো সে আমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করতে চায় যে সে আমার মধ্যে এমন কি পেল যে এতো প্রশ্রয় দিয়ে আমাকে এভাবে মাথায় তুললো, ওর ভাষায় "বউকে এতো মাথায় তোলার কি আছে? আর বউয়ের কথায় এতো নাচারই বা কি আছে?"
আবারও বলি, আমি হয়তো এই ভারতবর্ষে সেইসব ভাগ্যবতীদের মধ্যে একজন যাকে শ্বশুরঘরে পার করতে বাবামাকে কোন ছলেই মোটা টাকার যৌতুক দিতে হয়নি। যৌতুকপ্রথা যে এই আধুনিক ভারতবর্ষে কতো রকম ও কতো রঙ ধারন করেছে তা প্রতিমুহুর্তেই আমাদের চমৎকৃত করতে পারে। অন্য কোন আর্থিক বুদ্ধি থাকুক বা না থাকুক, বিয়ের সময় কনের পরিবারের কাছ থেকে যৌতুক নেবার যেন হাজারটা ফন্দি ফিকির অনায়াসেই মাথায় আসে এই জনগোষ্ঠীর। এই কয়েক বছর আগে আমার আরেক বন্ধু অন্তঃসত্বা হয়ে পড়ায় তার প্রেমিকটিকে বিয়ে করবার জন্য চাপ দিচ্ছিল। চল্লিশোর্ধ মহান প্রেমিকটি এই সুযোগে জানালো যে তার এখন স্ত্রী ও সন্তানের ভরণপোষণ দেবার ক্ষমতা নেই। আমার বন্ধু যদি ওকে বিশ/ত্রিশ লক্ষ টাকা দিতে পারে তবেই এ বিয়েটা হতে পারে। আমার বন্ধুটির পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থা সেসময় সংকটাপন্ন ছিল। কোথা থেকে যোগাড় করবে ওরা এতো টাকা। আমার কাছে দূঃখ করে বলতেই আমি নৈতিকভাবেই খুব ক্ষেপে গিয়েছিলাম। ওকে বললাম টাকার বিনিময়ে যেন কিছুতেই বিয়েটা না করে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি ও এই লোভী ছোটলোক ও ধান্দাবাজ লোকটাকে বিয়েই না করে। আর যদি বিয়ে নিতান্তই করতে হয় তবে ওর প্রেমিকের পরিবারের সাথে আলোচনা করে বা দরকার হলে আইনের আশ্রয় নিয়ে। আমার বন্ধুটি আমার ওপর ক্ষেপে গেল এতে, ওর মনে হলো আমি ওর ভালো চাইনা, ওকে হিংসা করি, ওর প্রেমিককে ও টাকা দেবে তাতে আমার কি যায় আসে? আমার কি যায় আসে তা খুবই নগন্য হয়তো কিন্তু ওর বাবার অনেক কিছুই গেলো আসলো। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা, প্রচন্ড অসুস্থ, সদ্য বিপত্নীক, বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে বহুদিন না ফেরা গ্রামের বাড়িতে দিনের পর দিন ছুটতে হলো জমি বিক্রি করতে। যে জমি ততোদিনে অন্যদের ভোগদখলে এবং দলিলপত্রে নানান জটিলতা। তারপরও কিছু জমি বিক্রি করে কিছু টাকা যোগাড় হলো ও প্রেমিকটির একাউন্টে আট লক্ষ টাকা জমা করা হলো। এক সুন্দর সন্ধ্যায় ঘরোয়া পরিমন্ডলে নিজের বাসাতেই আমার বন্ধুটি ওর প্রেমিকটিকে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করলো। বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রেমিকের পরিবারের কেউ বা প্রেমিকের কোন আত্মীয় অথবা বন্ধুও যোগ দিল না। যেভাবেই হোক না কেন, বিয়েটা তো হলো কিন্তু নব্য স্বামী দেবতাটি আমার বন্ধুটিকে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে গেলো না। কিছুদিন পর আবার আমার বন্ধুটি হতাশ হয়ে মন খারাপ করে আমার কাছে এলো। জানালো ওর স্বামীকে যদি বাকি টাকা (অন্তত বিশ লক্ষ) না দেয়া হয় ওর শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হবেনা। আর ওর স্বামী এবং শ্বাশুড়ি ওদের তাড়া দিচ্ছে যেন অন্তঃসত্বা অবস্থা প্রকট দৃশ্যমান হবার আগেই যেন টাকাটা জমা করা হয়। নইলে সমাজে মুখ দেখাবার জো থাকবেনা আর। ওর এই দূঃখ দেখে আমার কষ্ট হয়েছিল কিন্তু মেজাজ খারাপ হলো চুড়ান্ত। রেগেমেগে বললাম ওরা যেন এই ইতরদের আর একটা টাকাও না দেয়। ইতিমধ্যেই বিয়ে করার জন্য টাকা দিয়ে ওরা যথেষ্ট অন্যায় করেছে। আমার বন্ধুটি আবার ক্ষেপে গেল আমার ওপর বললো "আমার স্বামীকে আমি টাকা দিয়েছি, তোমার তাতে কি?" তারপরও আরো বহুদিন পার হলো। ওর বৃদ্ধ বাবা সেই প্রতীজ্ঞাবদ্ধ বিপুল অর্থ যোগাড় করতে পারলো না। আমার বন্ধুটি একরকম একলা একলাই বৃদ্ধ বাবার সহায়তায় একটা পুত্রসন্তান জন্ম দিল। ওর স্বামী কালেভদ্রে দেখা দিত। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা উপহার হাতে তথাকথিত বংশপ্রদীপের মুখও দেখে গেল। কিন্তু প্রতীজ্ঞা ভঙ্গের অপরাধে মাতা ও পুত্রকে নিজেদের বাড়িতে আমন্ত্রণটুকুও জানালো না।
আমি আমার বন্ধুদের হিংসা করিনা। কাছে থাকুক বা দূরে, চাই ওরা ভালো থাকুক। আমাদের শিক্ষা, আদর্শ, বিশ্বাস, জীবনযাপন, আত্মমর্যাদার বোধ, ভালোবাসার সজ্ঞা, ভালো থাকার সজ্ঞা এক না হোক, তবু এই ছোট্ট জীবনটায় যে যেখানে থাকুক, ভালো থাকুক। তবে আমার বরকে আমার একটু হিংসেই হয় মাঝেমাঝে কারন আমার বন্ধুরা ও পরিবারের লোকেরা যেন আমার চাইতে আমার বরটাকেই বেশি পছন্দ করে। যে বন্ধুদের গল্প আজ বললাম শুধুমাত্র ওদের স্বামীদের মতো না হলেও এই সমাজে পুরুষেরা লোকের প্রিয়পাত্র হয় আর আমার বর তো একজন আক্ষরিক অর্থেই ভালোমানুষ। এক বন্ধু তো একবার বলেই বসলো যে "He is an ANGEL!!!" যদিও সে কোনদিন আমার বরকে সামনাসামনি দেখেওনি, কথা বলা তো দূর। কিন্তু বলে রাখি, আমার বর কোন Angel নয়, ভালো খারাপ মিলেমিশে একজন রক্তমাংশের স্বাভাবিক মানুষ। আমার বর আমাকে সবসময় মাথায় তোলেনা, প্রতিটি দিন আমার প্রথম তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষক ও কঠোর সমালোচক হলো আমার বর। মাঝে মাঝে প্রশ্রয় তো দেয় বটেই মাথাতেও তোলে। নিজের বউ বলে কথা! সে আমার কথায় নাচেনা তবে যে ব্যাপারে আমার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আছে সে ব্যাপারে আলোচনা তো করেই, পরামর্শও নেয়। আবার প্রয়োজনবোধে পরামর্শ দেয়ও। রান্নাবান্না শিখে উঠতে না পারলেও প্রয়োজনে রান্নায় সাহায্য করতে পিছপা হয়না। আমাদের ঘরদোর আমরা দুজনে মিলেই পরিপাটি রাখি। আমার বন্ধুদের ও পরিবারের লোকেদের বরের কাছ থেকে পাওয়া বা অন্য কারো কাছ থেকে পাওয়া উপহারগুলো দেখাতে বা বলতে কিংবা আপ্লুত হয়ে ফেইসবুকেও পোস্ট করতে সহজ স্বাভাবিকভাবেই ভালো লাগে। বর কিভাবে কখন আর্থিকভাবে ও মানসিকভাবে আমাকে সাহায্য করেছে তাও বলি কাছের মানুষদের। হুম। তবে বলে বেড়াইনা কবে কি উপহার আমিও দিই আমার বরকে, কতো কতো নতুন রেসিপি শিখে নিই ওর জন্য আর পারি কিংবা না পারি কিভাবে সংকটে ওকে সাহায্য করার চেষ্টা করি। ছোট্ট একটা জীবন। শহরের কথিত আধুনিক নারী নয় বরং প্রবল সংগ্রামে পাল্টে যেতে থাকা সময়ের কন্যা হয়ে প্রতিদিন বাঁচি শত ক্ষত বুকে নিয়েই। নিঃস্ব অবস্থাতেও নিজেই নিজের সম্বল হতে চাই শেষ পর্যন্ত। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমরা মেয়েরা আজ ঘর থেকে বের হই, কাজে হোক বা একটু আয়াসের জন্যই হোক। স্বামী ও শ্বশুরঘরের অযথা কুচর্চা করে সময় নষ্ট নাই করলাম। সমাজের কিছু রীতি মেনে নিতে নারীরা এখনো বাধ্য, কিন্তু আইন ও সমাজের চোখে যা অন্যায় তা মেনে নেবার কোন মানে কি হয়? যে সম্পর্কে ন্যুনতম সম্মান নেই, ভরসা নেই, বিশ্বাস নেই, বিন্দুমাত্র উদারতা নেই, সে সম্পর্ককে জিইয়ে রাখার মানে প্রতিনিয়ত নিজেকেই হত্যা করা। নিজের আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে অন্যের মনোযোগ বা অনুকম্পা গ্রাহী হয়ে আদৌ কি কোন মানুষের বা সমাজের ভালো কিছু হতে পারে? একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন আত্মবিশ্বাসী নারী কিংবা পুরুষ অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে বাধ্য নয় কখনোই এবং আপোষকে "ভালোবাসা", "দায়বদ্ধতা", "অসহায়তা", "দ্বায়িত্ব", "উদারতা" যে নামেই কেউ ডাকুক না কেন, আপোষের অর্থ আপোষই হয়। অন্যায়ের সাথে আপোষ করাও আরেকটা অন্যায়।
একটা ছবি শেয়ার করলাম আমাদের দুজনের। শতভাগ সম্পূর্ণ নই আমরা বাস্তবিকভাবেই। একজনের প্রতি আরেকজনের অভিযোগও আছে অনেক। গুটিকয় কাছের মানুষ হয়তো কিছু কিছু জানতেও পারেন। কতোদিন বাঁচবো তা তো আমরা জানি না। একসাথেও সারাজীবন থাকবো কিনা জানিনা। তবে পারষ্পরিক বিশ্বাস ও সম্মান যেন অটুট থাকে আমাদের আজীবন।
No comments:
Post a Comment