Monday, December 27, 2021

টুকরো কথা : কেন???

২০১৯ সালের মার্চ মাসে প্রাইম ব‍্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আমি এবং আমার কাছের মানুষরা যে প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন হচ্ছি সেগুলো হলো "তোমার/ওর কি চাকরি চলে গিয়েছে?", "তোমার/ওর চাকরিটা কি ভালো ছিলোনা?", "চাকরিটা ভালো ছিলো তাহলে ছাড়লে কেন?", "এতো ভালো বেতনের চাকরি আর কি পাবে?", "তুমি কি চাকরি ছাড়তে ব‍াধ‍্য হয়েছিলে?", "ম‍্যানেজমেন্টের সাথে কি কোন সমস‍্যা হয়েছিল?", "চাকরিটা কি চুক্তিভিত্তিক ছিলো? চুক্তির মেয়াদ কি শেষ হয়ে গিয়েছিল?", "ব‍্যাংকে কি কাজ করতা যে ছেড়ে দিলা?" ইত‍্যাদি...ইত‍্যাদি...


আমি চট্টগ্রামের বাসিন্দা ছিলাম। বিবিএ পড়বার সময় ব‍্যাবসা শুরু করেছিলাম একটা। বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক জায়গায় ঘুরে বাজারের বাস্তব জ্ঞান লাভের চেষ্টা করেছি তখন, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত পরিশ্রম করেছিলাম। ব‍্যাবসাটা লাভজনকও ছিল কিন্তু পর্যাপ্ত পুঁজি, সমর্থনের অভাব ও পরিবারের ব‍্যাবসাবিরোধী মনোভাবের কারনে মনের মতো করে ব‍্যাবসাটা বেশিদিন এগিয়ে নিয়ে যেতে পারিনি। বিবিএ শেষ করে চাকরি খুঁজছিলাম চট্টগ্রামেই। কয়েকটা ইন্টারভিউ এ‍্যাটেন্ড করেছিলাম। পরীক্ষকরা কেউ কেউ বলেছিলেন "এই চাকরি তো তুমি করবেনা, কয়েকদিন পর এরচেয়ে ভালো চাকরি পাবে তারপর চলে যাবে।" কারো কারো প‍্রতিক্রিয়ায় মনে হয়েছিল ওই পদে কোন মেয়েকে ওনারা চান নি। একই সময়ে সমবয়সী অন‍্যদের মতো আমিও ব‍্যাংকের চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। ভালোই হচ্ছিল পরীক্ষাগুলো কিন্তু সফল হতে পারছিলাম না। সংসার সামলে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারলেও ঢাকায় গিয়ে পরীক্ষাগুলো দেয়া ছিলো একেকটা উটকো ঝামেলার মতো। তাছাড়া উড়ো কথা শুনতাম যে চট্টগ্রামের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট ব‍্যাংকগুলো গ্রাহ‍্যই করেনা। সরকারি চাকরির চেষ্টা করছিলাম না কারন সরকারি অফিসগুলোর পরিবেশ আমার পছন্দ নয়। একদিন একজন আমাকে বলেছিল "প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট হয়ে তুমি ব‍্যাংকের ম‍্যানেজমেন্ট ট্রেইনির পরীক্ষা দিচ্ছ? শুধু শুধু সময় নষ্ট করছো। তারচেয়ে ব‍্যাংকের ক‍্যাশ ডিপার্টমেন্ট কিংবা টিএ এইসব পদের জন‍্য চেষ্টা করো।" আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ‍্যালয়ে পড়তাম। অনিয়মিত ক্লাস ও সার্বিক পরিস্থিতি অপছন্দ হওয়ায় এক বছরের ক্রেডিট ট্রান্সফার করে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ শেষ করেছিলাম। প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির পড়াশুনা যুগোপযোগী, নিয়মিত ও উচ্চমানসম্পন্ন ছিল, অন্তত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায়। যাই হোক মন্তব‍্যটা সেদিন আমার খুব লেগেছিল। আমি ঠিক করলাম ব‍্যাংকের চাকরির পরীক্ষা আমি আর দেবোই না বরং প্রশ্নহীন যোগ‍্যতা অর্জন করবো যেন ব‍্যাংক আমাকে ডেকে নিয়ে চাকরি দেয়। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব‍্যাংক ম‍্যানেজমেন্ট এ মাস্টার ইন ব‍্যাংক ম‍্যানেজমেন্টে ভর্তি হলাম। ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হবার সাত দিনের মধ‍্যে আমার ব‍্যাচের প্রত‍্যেকের কয়েকটি লিডিং ব‍্যাংকে ইন্টারভিউ হলো এবং আমরা সবাইই ম‍্যানেজমেন্ট ট্রেইনি হিসেবে যোগদান করলাম। যাদের সেই তারিখ পর্যন্ত সিজিপিএ সবচেয়ে বেশি ছিল আমরা যোগ দিলাম প্রাইম ব‍্যাংকে কারন প্রাইম ব‍্যাংকের টপ ম‍্যানেজমেন্ট আমাদের অত‍্যন্ত সম্মান দিয়েছিল এবং তখনকার ইন্ডাস্ট্রি এমটি হায়ারিং রেটের চেয়ে বেশি বেতন ও সুযোগসুবিধা অফার করেছিল। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির ০৬ তারিখের দুপুর ২:০০ টায় আমরা ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম, সেদিনই রাত ৯:০০ টায় আমরা সবাই চাকরির চুক্তিপত্রে সাক্ষর করেছিলাম। একবছর ট্রেইনিং এর পর করপোরেট ডিভিশানে আমার ও ব‍্যাচের মোট ছ'জনের স্থায়ী পোস্টিং হয়েছিল। প্রথমে মতিঝিলের পুরোনো ভবন তারপর গুলশানের সর্বাধুনিক দৃষ্টিনন্দন ভবনে কেটেছে ছয় বছরের কর্পোরেট লাইফ। শেষ পর্যন্ত কর্পোরেট কাস্টমার ডিল করে গেছি এ‍্যাসোসিয়েট রিলেশানশিপ ম‍্যানেজার হিসেবে। আমি ছিলাম অত‍্যন্ত সৌভাগ্যবানদের মধ‍্যে একজন যার কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে যোগ‍্য ও পেশাদারিদের একাংশের সঙ্গে। সেই চুড়ান্ত প্রতিযোগিতাপূর্ণ জায়গাটিতে সহকর্মীদের সম্মান ও ভালোবাসা পেয়েছিলাম আমি। ওরা আমাকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিল নিজের ওপর আরো বেশি করে। আমি শিখেছিলাম দিন শেষে ব‍্যাক্তিগত পছন্দ অপছন্দের উর্ধ্বে মূল‍্যায়িত হতে বাধ‍্য ব‍্যাক্তির পেশাদারিত্ব, সততা, যোগ‍্যতা ও পরিশ্রম। ওই ছয় বছরের করপোরেট লাইফ আমার কাছ থেকে নিয়েছে যতোটা দিয়েছে তারচেয়ে অনেক বেশি। সবচেয়ে বড় কথা আমি আমার কাজটাকে ভালোবাসতাম। রিয়েল লাইফে যখন এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড কোন ক্লায়েন্টকে সার্ভিস সল‍্যুশান দিতে পারতাম, দেশের কোন উন্নয়ন কাজের এপ্রেইজাল করতে পারতাম, কিংবা যখন কোন ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানকে সাহায‍্য করতে পারতাম ঋণ পরিশোধ করতে তখন মনে হতো আমি ও আমার টিম সত‍্যিই সমাজের জন‍্য কিছু একটা করতে পারছি। 


না। চাকরিটা আমার চলে যায়নি বা আমি চাকরি ছাড়তে বাধ‍্য হইনি। কিংবা ম‍্যানেজমেন্টের সাথে আমার কোন ঝামেলাও হয়নি। বরং রেজিগনেশান লেটার সাবমিট করবার পর নিজের ডিভিশান তো বটেই অন‍্য ডিভিশানের সহকর্মীরাও আমাকে রেজিগনেশান  ফিরিয়ে নিতে বলেছিল। কোন ক্লায়েন্ট বা বলেছিল তাদের প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে। কেউ বলেছিল "আমি ব‍্যাংক সুইচ করছি তুমিও চলো আমার সাথে"। এখন প্রশ্ন হলো, তবে কেন চাকরি ছেড়ে দিলাম? 


জীবনটা আমার কাছে একটা একাগ্র যাত্রার মতো। উপভোগ‍্য ও দর্শনীয় একটা যাত্রা। তার আবার একাধিক বা বহু চলার পথ। প্রতিটা পথে চলবার জন‍্য, জানবার জন‍্য অন‍্য আর সব পথগুলোকে সাময়িকভাবে বা চিরকালের মতোই ছেড়ে এগিয়ে যেতে হয়। আবার কখনো প্রয়োজনে পিছিয়েও আসতে হয়। এই স্বপ্নময় জীবনে স্বপ্নগুলোকে পূরণ করতে কখনো খুব হিসেব করে ছক কষে চলতে হয় আবার কখনো স্বপ্নগ্রস্তের মতোও হেঁটে যেতে হয়। করপোরেট চাকরি করাটা আমার স্বপ্ন ছিল। অনেক মানুষের সাথে কাজ করবো ঝাঁ চকচকে পরিবেশে, মাস শেষে মোটা মাইনে পাবো, নিজের একটা পুঁজি হবে, নিজের আর প্রিয়জনের শখ ও প্রয়োজন মেটাবো। চাকরিতে যোগদান করাটা যেমন নিজের জীবনে নিজেরই একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল, চাকরি ছেড়ে দেয়াটাও নিজেরই একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। কে কি ভাবলো তা নিয়ে ভাবিনি কখনো, এখনও ভাবিনা। উদ্দেশ্য নয়, লক্ষ্য নয়, কিছু স্বপ্ন এমন হয়, যার জন‍্য সবকিছু ছাড়া যায়, যার জন‍্য খুব অল্প সম্বলে জীবন পার করা যায়, সন্তুষ্ট থাকা যায়। তেমনি কিছু স্বপ্ন লালন করি নিজের ভেতর। প্রতিদিন স্বপ্নগ্রস্তের মতো একটু একটু এগিয়ে চলি। হেরে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যাই, আবার উঠে দাঁড়িয়ে এগোতে চেষ্টা করি। হেরে যাওয়া আমাকে ভাবায় না কারন পৃথিবীতে হেরে যাওয়া মানুষের সংখ‍্যাই বেশি, হার-জিত, সফলতা-অসফলতা দিয়ে যোগ‍্যতার বিচার করা যায়না সত‍্যিকার অর্থে। জীবনের কাছ থেকে কি পেয়েছে কেউ কিংবা কি পায়নি তা শুধু ব‍্যাক্তি মানুষই জানে। মানুষের জন্ম পেয়েছি এক। দোয়েলের ফড়িঙের নয়। তবু এই পৃথিবীরই এক   যাদুময় পথ ধরে এই জীবন যাত্রা। কি আর করবো, জন্মেছি, তৈরী হয়েছি এক হিসেবে কাঁচা, স্বপ্নগ্রস্ত মানুষ হয়ে।

No comments:

Post a Comment

English Translation of Bangla Folk Song: Fakir Lalon Shah; চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি; Forever I Nurtured a Mysterious Bird

 Forever I Nurtured a Mysterious Bird Forever I nurtured a mysterious bird, which never discloses its identity. For this grief, my eyes ...