Saturday, June 26, 2021

টুকরো কথা : পিরিয়ড

ক্লাস সেভেনের বার্ষিক পরীক্ষা চলছিল তাই ভোরে ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়েছিলাম। হঠাৎই খেয়াল করলাম ফ্রকের নিচের দিকে সাদা ঝালরে ছোপ ছোপ খয়েরি (ঠিক যেন খয়রি ও নয়) দাগ। অতোটা পাত্তা দিলাম না দেখে বরং মুখহাত ধুয়ে ঠিকঠাক লক্ষ্মী মেয়ের মতো পড়তে বসলাম। কিন্তু হঠাৎই একটা অন‍্যরকম অস্বস্তি হওয়াতে ছুটে বাথরুমে গেলাম। ভয়ে আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে পড়লাম কারন খেয়াল করে দেখলাম প‍্যান্টিতে তাজা রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে আর জামার পেছনেও ছোপ ছোপ  টাটকা রক্ত। কোত্থেকে রক্ত বেরুচ্ছে তা বুঝতে পেরে গা হাত পা আরো হীম হয়ে গেল। হঠাৎই মনে হলো আমার মনে হয় বাচ্চা হচ্ছে কারন কার কাছে যেন শুনেছিলাম বাচ্চারা পেটের ভেতর রক্তের মধ‍্যে ডুবে থাকে আর প্রসবের সময় রক্তসহ বেরিয়ে আসে। আমার মানসিক অবস্থাটা ঠিক কি ছিল সে মুহূর্তে তা আসলে ভাষায় বোঝানোটা মুশকিল। ম‍্যান্সট্রুয়েশান বা যাকে আমরা চলতি ভাষায় বলি পিরিয়ড, তার সম্পর্কে কোন ধারনাই আমার ছিলনা। বাড়িতে মা ছিল, বড় বোন ছিল, স্কুলের বন্ধুরা, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী কেউ কোনদিন এই প্রসঙ্গটাই কোনদিন টানেনি। আতঙ্কে পরীক্ষার পড়া মাথায় উঠলো। মা কে ভীষণ ভয় পেতাম তাই কিছু বল্লাম না আর বোনকেও বল্লাম না যদি মাকে বলে দেয় সেই ভয়ে। আর বাবা কিংবা ভাইদের এই লজ্জ্বাজনক কথা বলার প্রশ্নই ওঠেনা। কিন্তু রক্তের দাগতো আর বেশিক্ষণ চাপা দিয়ে রাখা যায় না। ব্রেকফাস্ট শেষ করে উঠতেই মা আর বোন ঠিক ধরে ফেললো আমাকে। কিন্তু খুবই অদ্ভুত ব‍্যাপার মুখে টু শব্দটাও করলো না দুজনে, শুধু যেন চোখে চোখেই নিজেদের মধ‍্যে বললো কিছু একটা। পরে আমার মাই বুঝিয়ে দিয়েছিল কিভাবে স‍্যানিটারি ন‍্যাপকিন ব‍্যাবহার করতে হবে, বললো এখন থেকে প্রতি মাসেই এমনটা হবে কিন্তু এর বেশি কিছু আর বললো না। শুনে এতো কান্না পেয়েছিল, ভাবছিলাম কি এমন অন‍্যায় করেছি যে এমন খারাপ একটা অসুখ হলো।


এই ব্লগটাতে অনেক কিছুই লিখে রাখি, তো ভাবলাম ম‍্যান্সট্রুয়েশানের অভিজ্ঞতা নিয়েও কিছু লিখি। এ তো কোন নিষিদ্ধ বিষয়বস্তু নয় (সত‍্যি বলতে কোন বিষয়বস্তুকেই আমি নিষিদ্ধ বলে মনে করিনা) বরং জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতাই, বিশেষ করে যখন প্রবল রক্তপাতের কারনে আর পেশীর ব‍্যাথার কারনে আমি ঘুমাতে পারছিনা মোটে সারারাত, দূর্বলতায় নিস্তেজ হয়ে পড়েছি প্রায়, আর সেই সাথে চারদিকটা ঘোলা দেখছি, তখন ম‍্যান্সট্রুয়েশান ছাড়া আর কি নিয়েই বা লিখবো।


ক্লাস এইটে যখন পড়ি তখন এক ঈদের সময় পিরিয়ড হয়েছিল। ঈদের জামা পরে সারাদিন বাসায় বসে ছিলাম বুক ভরা প্রবল চাপা কষ্ট নিয়ে। এমন হয়েছে সমুদ্রে ঘুরতে গেছি কিন্তু পানিতে নামতে পারিনি। বাইরে কোথাও স‍্যানিটারি অব‍্যবস্থার কারনে প‍্যাড পাল্টাইনি দীর্ঘ‍্য সময় তাই সাময়িক ইনফেকশানেরও স্বিকার হতে হয়েছে কখনো। তবে এ কথা সত‍্যি যে আমি সেই ভাগ‍্যবতীদের মধ‍্যে একজন যাদের ম‍্যান্সট্রুয়াল ক্র‍্যাম্প হয় না তেমন একটা। আমার এক বন্ধুর এমন অবস্থা হয় যে প্রায় মাসেই হসপিটালে ভর্তি হতে হয়। এক বন্ধু একবার অফিসের মিটিংয়ের মধ‍্যেই ব‍্যাথায় অজ্ঞ‍ান হয়ে গিয়েছিল। আরেক বন্ধু একদিন দেখি ফেইসবুকে স্ট‍েটাস দিল পরজন্মে সে যেন আর নারী হয়ে না জন্মায়। আমি মনে মনে খুবই কৃতজ্ঞ এই কারনে যে পিরিয়ডের ভোগান্তিটা এখনো পর্যন্ত আমার সহনীয় পর্যায়েই থাকে।


পিরিয়ডকে আমরা নারীরা যেভাবেই হোক সহ‍্য তো করে নিই জীবনের সিংহভাগ, কাউকে জানতে না দিয়ে, বুঝতে না দিয়ে। নিতান্ত অপারগতা ছাড়া নিজেদের দায়িত্ব কর্তব‍্যগুলোও পালন করে যাই এই পীড়াদায়ক রক্তপাতকে যুঝেই, তবু একেই নারীর দূর্বলতা, অশুচিতা, অযোগ‍্যতা কিংবা পাপের শাস্তি বলেও বারবার নারীকে ধিক্কার দেয়া হয়েছে এবং এখনও দেয়া হয় প্রত‍্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এই তথাকথিত সভ‍্য সমাজে। অন‍্য ধর্মের মতামত জানিনা, কিন্তু ইসলামিক এক বইয়ে পড়েছিলাম আল্লার নির্দেশ অমান‍্য করে গন্দম ফল খাওয়ার অপরাধে নারীজাতির ওপর অর্পিত অনেকগুলো শাস্তির একটি শাস্তি হলো ঋতুস্রাব। জানিনা ঠিক এর কোন কোরানিক ভিত্তি আছে, না কি এ শুধু সেই নির্দিষ্ট লেখকের মনগড়া গালগল্প। তবে যেটাই হোক না কেন এ এক ইসলাম বিরোধী শাস্তিই বটে। কারন ইসলামে তো একজনের পাপের ভাগ আরেকজনের ঘাড়ে চাপানোর নিয়ম নেই, শাস্তিভোগ তো দূর। সব ধর্মেই নারীকে অশুচি অপবিত্র মনে করা হয় এই পিরিয়ডের কারনে। পিরিয়ডের সময়ে কোন ধর্মীয় আচার পালন করা যাবেনা, সুরা বা মন্ত্রপাঠ করা যাবেনা, এমন কি ধর্মীয় ভাবে পবিত্র কোন স্থানেও প্রবেশ করা যাবে না। কিছু কিছু ধর্মীয়ভাবে পবিত্রস্থানে তো নারীদের সবসময়ই যাওয়া নিষেধ। আমার বাবাকে যেখানে কবর দেয়া হয়েছে সেই গোরস্থানে নারীদের প্রবেশ নিষেধ। একজনকে কারন জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন, বলেছিল, "কবরস্থান পবিত্র জায়গা, এই জন‍্য আর কি মহিলাদের ঢোকা নিষেধ"। জবাব কি হতে পারে জানতাম তারপরও যখন জিজ্ঞেস করলাম পবিত্র জায়গা তো জানি, তা মহিলাদের ঢোকা নিষেধ হবে কেন? বললো "বুঝলেন না, মহিলাদের তো... ওই যে... মাসিক হয়"। এই বর্বর অসভ‍্য ইতর লোকগুলো ঠিকই জানে একজন মহিলার তিনশ পঁয়ষট্টি দিন মাসিক হয় না। নারীর আবেগ, অনুভুতি, কষ্ট, এমন কি প্রিয়জন হারানোর শোকও এদের কাছে বিদ্রুপের বিষয় মাত্র।


আমাদের সমাজের সভ‍্য মানুষেরা পিরিয়ড নিয়ে নারীবিদ্বেষী ও পশ্চাৎপদ ধারনাগুলো থেকে বেরিয়ে তো এসেছে কিন্তু তারপরও পিরিয়ড প্রসঙ্গটা এখনও যেন লোকসন্মুখে আলোচনার অযোগ‍্যই থেকে গেল, যেন পরোক্ষভাবে একটা লজ্জাজনক বিষয় হিসেবেই চিহ্নিত থেকে গেল। কোন কোন পরিবারে এমনও দেখেছি স‍্যানিটারি প‍্যাডের বিজ্ঞাপনের সময় টিভির চ‍্যানেল পালটে দেয়া হয়। বিশেষ কোন সুবিধা নয়, ম‍্যান্সট্রুয়েশান নিয়ে সচেতন হোক সমাজের সর্বস্তরের নারী ও পুরুষ, প্রয়োজনে ম‍্যান্সট্রুয়েশান নিয়ে যে কোন জায়গায় কথা যেন বলে যে কেউ। প্রবল মাইগ্রেনের ব‍্যাথা নিয়ে যেমন কেউ সাহায‍্য চায়, সহ‍্যের অযোগ্য পিরিয়ড ক্র‍্যাম্প নিয়েও যেন তেমনি চাইতে পারে, স্বাভাবিকভাবে, কোন লজ্জা না পেয়ে, যে কারো কাছেই, হোক পরিবারের সদস‍্য, অফিসের সহকর্মী কিংবা কোন অচেনা ব‍্যাক্তি। বিশেষ করে পিরিয়ড নিয়ে লজ্জা, লুকোচুরি আর অশুচিতার বিশ্বাস পরিবারেই ঘুচুক সবার আগে।






No comments:

Post a Comment

English Translation of Bangla Folk Song: Fakir Lalon Shah; চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি; Forever I Nurtured a Mysterious Bird

 Forever I Nurtured a Mysterious Bird Forever I nurtured a mysterious bird, which never discloses its identity. For this grief, my eyes ...