বন্যার পানি যখন তাঁতির বাড়িতে প্রায় কোমর ছুঁইছুঁই তখন দুটো স্বামীস্ত্রী ব্যাঙ ঢুকে পড়ল ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ। শুধু ব্যাঙগুলো নয় কিছু কুঁচো মাছ, নানান জলের পোকাও ঢুকে পড়ল। তবু লোকে ধুয়ো তুলে গেয়ে চললো "তাঁতির বাড়ি ব্যাঙের বাসা"। তা ব্যাঙ দম্পতি ভাবলো এই বর্ষাটা এই বাড়িটার ভেতর আর আঙিনার গন্ডির মধ্যেই কাটিয়ে দেবে। অতো লোভ করে কাজ নেই, পরিমিত খাবার পেয়ে যাবে এখানে আর বেশ একটা রিসোর্ট রাসোর্ট পরিবেশে এতোদিনের ভুলে যাওয়া হানিমুনটা সেরে নেবে এখানেই। তারমধ্যে যদি কটা ছেলেপুলে হয়ে যায় তবে আরও ভাল, সোসাইটিতে একটু দাপটে স্বপরিবারে দল বেঁধে চলতে পারবে। চিন্তার তেমন কিছু নেই, এরা বাঙালি, সুপ্রাচীন কাল থেকে বুদ্ধের পূর্বাত্মাদের অনুগত, তাই মনে খুব দয়ামায়াও আছে আর ব্যাঙট্যাঙ খায় টায় না। তাছাড়া এই অজপাড়াগাঁয় ওইসব নচ্ছার বায়োলজির ছাত্রদেরও উৎপাতও নেই। এর মধ্যে আবার শাপে বর হল কারন তাঁতির বউটা ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে তাাঁতিকে আচ্ছামত ভিখিরি, ছোটলোক, কিপ্টে ইত্যাদি ইত্যাদি বলে গালমন্দ করে আর জীবনে ফিরবেনা বলে তার সমস্ত সম্পদ গুছিয়ে নিয়ে একটা নৌকো ডেকে বাপের বাড়ি চলে গেল। তাঁতি বেচারা কি আর করবে, ঘরের ভেতর প্রায় চার ফুট উঁচুতে বাঁধা মাচাটায় প্রথমে সারাদুপুর দ হয়ে মুখ ঝুলিয়ে বসে রইলো, তারপর ওই ঝোলা মুখ নিয়েই একটু আড়মোড়া ভেঙে মাচার ওপরেই দুমুঠো চাল আর একটা বড় মতো আলু চড়িয়ে দিল। ব্যাঙ দম্পতির খুব মন খারাপ হল তাঁতির এমন দশা দেখে। তারা একজন আরেকজনকে জড়িয়ে প্রতীজ্ঞা করলো যাই হয়ে যাক না কেন আমৃত্যু একসাথেই থাকবে, কোনদিন একে অন্যকে ছেড়ে চলে যাবেনা।
এমনি করে করে পুরো একটা সপ্তাহই চলে গেল। মাঝে শুধু একদিন একটা কুঁচকুঁচে কালো ঢোঁড়া সাপ এসেছিল খাবারের খোঁজে, তখন ব্যাঙ দম্পতি মাচার ওপর একটা বেতের গোল চালুনির নিচে কোনরকমে গুঁটিশুঁটি মেরে লুকিয়ে ছিল। আর তেমন কোন সমস্যাই হয়নি এ কদিনে। পোকাগুলো যে বংশবিস্তারের মহোচ্ছব লাগিয়ে দিয়েছে, এমন চলতে থাকলে, আগামী চৌদ্দ জেনারেশানের অন্তত খাবারের অভাব হবে না। বেশ রাজার হালেই ওদের দিন কাটছে, সকাল হতেই বাইরে বেরিয়ে পড়ে সূর্যের আলোয় ঠান্ডা হাওয়ায় বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বোঝার চেষ্টা করে চারদিক দেখে আর আনন্দিত হয় পানি নামার কোন লক্ষণ দেখতে না পেয়ে। বরং মনে হয় যেন একটু একটু বেড়ে চলেছে। সারাদিন থইথই পানির ওপর ঝাঁপাঝাঁপি করে, নানান রকম সাঁতারের আর লাফালাফির কসরত অনুশীলন করে কিংবা ভেসে থাকা কোন নারকেলের খোলের ওপর শুয়ে শুয়ে চোখ বুঁজে রোদ পোহায় ব্যাঙ দম্পতি আর মাঝে মাঝে গানও গেয়ে ওঠে আবেশে। খাওয়া দাওয়া তো আছেই, আর যাই হোক খাবারের অভাব এখানে ওদের নেই। আর রাত হলে তাঁতির বাড়িতে মাচার ওপর একটা ভুসি রাখা মাটির হাড়িতে দুজন উষ্ণ আরামে প্রেম করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।
আর ওদিকে তাঁতি আছে মহা চিন্তায়, মহাজনের তাঁতঘর এখন পুরোই পানির নিচে, সব যন্ত্রপাতি হয়তো এবার নষ্টই হয়ে যাবে। হাতে টাকাকড়ি বলতে গেলে নেই কিন্তু ঋণের দেনা হপ্তায় হপ্তায় খাড়া থাকে। এজেন্টগুলো আপাতত এমুখো হচ্ছেনা কিন্তু পানি নেমে গেলেই টাকা টাকা করে মাথা চিবিয়ে খাবে। সেই যে এম পি সাহেব এসেছিল কোমর পানি থাকতে কিছু বাজার সদাই দিয়ে গিয়েছিল তাও এখন বাড়ন্ত। বউটাও এই বিপদের দিনে রাগ দেখিয়ে চলে গেল। কলাগাছ দিয়ে একটা ভেলা সে বিনিয়েছে বলে তাও রক্ষে। এদিক সেদিক একটু যেতে পারে। বাজারে গিয়ে বন্ধুর দোকানে মোবাইলটা একটু চার্জ দিতে পারে। টাকার খুব অভাব তারপরও একটু মাঝে মাঝে ডাটা কিনে নেয় আর অনলাইনে রেডিও টেডিও শোনে, একটু ফেসবুকে উঁকিঝুঁকি মারে। তিনকুলে তারতো আর কেউ নেই, বউ থেকেও নেই, একটু বিনোদনও তো দরকার হয় জীবনে। এইসব আগডুমবাগডুম ভাবতে ভাবতে সে বাক্স খুলে লাল টুকটুকে কাচ্চা জরীর কাজের জামদানিটা বের করে দেখতে লিগলো। বাবার বোনা এই রেশমের জামদানিটা এতো অন্যরকম নকশার আর এতো নিখুঁত যে শুধু দেখতেই ইচ্ছে করে। এতটুকু খাদ নেই এতে, না সুতোয়, না জরিতে, না নকশায়, না বুনোনে। বাবা কোনদিন এটা বেচতে চায়নি আর মাকেও দেয়নি বলে কত কিছুই না সহ্য করেছে জীবনে। একটু বড় হবার পর অনেকবার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল এতো দামি একটা জামদানি বোনার টাকা সে কোথায় পেল আর এতো খাঁটি সব উপকরনই বা পেল কোথায়। সেইতো জন্ম থেকে দেখে এসেছে তাঁতঘরে সব আটপৌরে সুতো কিংবা পাটের শাড়িকাপড় আর কিছু গামছা বুনতে। মহাজনের তাঁতঘরে তো অর্ডার বা পাইকারি হিসেবের বাইরে কিচ্ছু বোনার জো নেই আর তাছাড়া আছে গোটা চারেক তাঁত কিন্তু সে আর যাই হোক অমন নিখুঁত জামদানি বোনার যোগ্য নয়। এই তল্লাটে কোথাও জামদানি তো কেউ বোনে না আর হাটেও বিক্রি নেই। সবচেয়ে বড় কথা বাবা এমন জামদানি বুনতেই বা শিখলো কোথায়। বাবাকে জিজ্ঞেস করলে বাবা শুধু হাসতো আর মাঝেমাঝে বিরক্ত হয়ে থাকলে গালাগাল দিয়ে হাতের কাছে যা পেত তাই ছুঁড়ে মারতো। শুধু একদিন চাঁদনি পসর রাতে দেরুদের পুকুর ঘাটে রবি কাকার মাতনের গান শুনে হঠাৎ আনমনা হয়ে বলেছিল "চাঁন্দের বুড়ির কথা মতো স্বপ্নখান বুইনে থুয়েছি সেই কবে থিকে। আ রবি তোমার গলাখানে দরদ বড়। চাঁন্দের বুড়িরে আমি কবানে। ওই চান্দের মিয়ের যেদিনকে বে হবে সেইদিন ওই লাল টুকটুক জামদানিখান পইরে যখন সে চুল বাঁধবে, চন্দনের নকশা পরবে তখন তুমি একখান গান গেও। এই মাতনের গান নয়, একখান বের গান বাইন্ধো তো রবি জান।" সবাই ভেবেছিল হাঁড়িয়া খেয়ে আর দম টেনে বাবার মাথাটা পুরোই বিগড়েছিল সেদিন।
এতো করে লুকিয়ে রেখেও শেষে এই জামদানিটাই কাল হলো। তাঁতির সুন্দরী আর দেমাকি নতুন বউটা বন্যার সময় জিনিস পত্তর সরানোর সময় ঠিক দেখে ফেলল বাক্সটা আর খুলতেও বাধ্য করলো তাঁতিকে। তারপর জামদানিটা দেখেতো সে একেবারে পাগলই হয়ে গেল। প্রথমে বউটা ভেবেছিল এ বুঝি তার স্বামী চুপিচুপি তাকেই উপহার দেবে বলে এনেছে। কিন্তু পরে যখন শুনলো এ তার জন্য নয় এবং কারো জন্যই নয় তখন সে ওই কোমর সমান পানির মধ্যেই তেলে বেগুনে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। আর তার হৃদয়ও এমন ভেঙ্গে চুরচুর হয়ে গেল যে তার এমন লোহারঙা দিব্য কানাই বরকে ছেড়ে সে বাপের বাড়ি চলে যেতে বাধ্য হল।
তাঁতির যখন কাঁচা বউটার শোকে ঘুম আসছিল না মোটেও আর সে অলুক্ষুনে জামদানিটা বুকে জড়িয়ে মনে মনে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছিল সে রাতে, তা দেখে ফেললো ব্যাঙ দম্পতি। ওরা তখন একটু খিদে পেয়ে যাওয়ায় চারদিকে আতিপাতি দেখছিল। বউ ব্যাঙটা যেইনা দেখলো সেই লাল টুকটুকে চকচকে সোনার কারুকাজের জামদানিটা, এক শীতল প্রতীজ্ঞার গলায় বর ব্যাঙকে শুধু বললো "ছেলেপুলে যদি চাও, ওই চকচকে কাজ লাল তত্ব আগে এনে দাও এই পায়ে।"
ব্যাঙ দম্পতি তক্কে তক্কে থাকতে লাগলো। ওদের হানিমুন একেবারে সিকেয় উঠলো। বউ ব্যাঙ খায়না, সাঁতরায় না, লাফায় না, গান তো দূরে কথাও কয় না। এসব দেখে বর ব্যাঙটাও গুম মেরে গেল। সে খেয়াল করলো সারা রাত বউব্যাঙটা ওই বাক্সটার দিকেই অপলক তাকিয়ে থাকে।
এদিকে পানি বাড়তে বাড়তে মাচাও ছাড়িয়ে গেল। তাঁতি তাই বাক্সপেটরা সব নিয়ে একেবারে ঘরের চালেই একটা পাতার ছাউনি মতো বানিয়ে আশ্রয় নিল। ব্যাঙ দম্পতিও গেল সাথে সাথে। তাঁতির টাকাপয়সা, খাবার দাবার, মোবাইলের ব্যালেন্স, চার্জ সব শেষ হয়ে গেল। সে শুধু যেমন বাজারে শুনেছিল তেমনই এক মনে রিলিফের নৌকোর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। আরো দুদিন চলে গেল কিন্তু কারোরই দেখা মিললো না। আশেপাশের প্রতিবেশীরাও ঘরদুয়ার ফেলে কোথাও একটা চলে গেছে ততোদিনে। তার মধ্যেই আবার তাঁতির হল ভীষণ পেট খারাপ। ক্ষুধায় আর পানিশূণ্যতায় সে প্রায় মরতে বসলো। চোখে ঘোলা দেখতে শুরু করলো আর চোখ খোলা রাখতেও কষ্ট হচ্ছিল তার। এমন সময়েই সে দেখতে পেল ব্যাঙ দম্পতিকে। কিভাবে জানি, হয়তো ক্ষুধায় ওর মাথাটাই বিগড়েছিল তাই হয়তো, সে ব্যাঙ দম্পতির কথাও যেন বুঝতে শুরু করলো। বর ব্যাঙটা ভয়ে ভয়ে কাঁচুমাচু করে বলে উঠলো "দেখুন আপনার তো খুব খারাপ অবস্থা, যদি চান আমরা হয়তো কিছু সাহায্য করতে পারি। এই ধরুন কিছু খাবার দাবার জোগাড় করে দিতে পারি। তবে একটা শর্তে। ওই চকচকে কাজ লাল তত্ব চাই আমার বউয়ের।" তাঁতি ঝিমুতে ঝিমুতে বললো "ও! এ আর এমন কি। এখন মরতে বইসেছি, কি আর করবো? তোমার বউরে কও এসে নিয়ে যাক।" ব্যাঙ বউটা ভীষণ খুশি হয়ে যেইনা তাঁতির নাগালের মধ্যে গেছে তাঁতি যেন অবশিষ্ট সমস্ত শক্তি দিয়ে খপ করে ধরে ফেললো বউ ব্যাঙটাকে আর বর ব্যাঙটা ভয়ের চোটে ইয়া বড় বড় লাফ মেরে পগার পার হয়ে গেল।
তাঁতি একটু বল পেয়েছে শরীরে গতকাল থেকে। পেটটা এখনো পুরোপুরি ঠিক হয়নি তাও যেটুকু আমিষ পেয়েছে তাই ভাগ্য। ঝিমিয়ে ঝিমিয়েই সে এই নীল জলের দিগন্তের দিকে তিকিয়ে আছে তার জামদানির বাক্সটা বুকে আঁকড়ে। বন্যার পানি মনে হচ্ছে নামছেও কিছুটা। আকাশ পরিষ্কার, ঠান্ডা মিষ্টি হাওয়া বইছে। দেখলো ওই সামনের তাল গাছটার মাথায় দুটো শকুন বসে আছে। এতো ক্লান্ত চোখেও চারপাশে যতদূর চোখ যায় দেখে তার মনে হতে লাগলো আহা কি অপরুপ সুন্দর! সূর্যটা যখন ঠিক মাথার ওপর তখন একটা আকাশ বাতাস জাগানো ইঞ্জিনের শব্দে তাকালো সামনে, কোন বড় রিলিফের নৌকোই নিশ্চই, এখোনো ঠিক ঠাওরে আসছে না। সেই সাথে দেখলো একটা ছোট তালের কোঁদা হেলতে দুলতে আসছে তাতে লাল টুকটুকে শাড়ি পরা চাাঁদের মেয়ে। আরে! কাঁচা বউটা ফিরে এসেছে তাইলে?
No comments:
Post a Comment