এই শহরটা কখনোই নিস্তব্ধ হয়ে যায় না। মাথার ভেতরের স্বরগুলোর মতো সারাক্ষণই জানান দিতে থাকে ক্ষয় হতে থাকা অস্থির প্রাণের উপস্থিতি। গাড়ির হর্ণগুলোর একনাগাড় এলোপাথাড়ি নানানমূখী নানান দূরত্বের শব্দে মাথার ভেতরে লেজারের সুক্ষ সুক্ষ সুড়ঙ্গ পথে একটু খেয়াল করলে টের পাওয়া যায় কেমন শীতল জল গড়িয়ে চলেছে। এ্যাম্বুলেন্সের শব্দ এখন আর বিচলিত করেনা, হয়তো কাউকেই আর করেনা। ফেরিওয়ালার হাঁক শোনা যায় মাঝেমাঝে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত। এই এতো উঁচুতে যারা থাকে তাদের জন্য এটা একটা বিচলিত হবারই বিষয় শুধু কারন ফেরিওয়ালাকে খুঁজে পাওয়াও যায়না আর বোঝাও যায়না ঠিক কোত্থেকে অমন হেঁকে যাচ্ছে কিন্তু ওরা ঠিক মনে করায় ঘরে কি কি বাড়ন্ত। ভিখিরির আবেদনও ভেসে আসে মাঝেমাঝে। কখনও ঘোর আয়েসি সন্ধ্যায় কোন একটা ভিখিরি করুন আর্তনাদ করে ওঠে আর চিরচির করে দেয় রাস্তার এমাথা ওমাথা থেকে আকাশ পর্যন্ত। আজকাল আমরা ওদের আগের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করি আর ছোট ছোট নিঃশ্বাসগুলো হয়তো নিজেদের কাছেই গোপন করতে চাই। সারাদিন সারাসন্ধ্যা মেরামতি ঠুকঠুক ঠাকঠাক ঠ্যাকঠ্যাক খ্যাঁচখ্যাঁচ ঘ্যাসেরঘ্যাসের শোঁশোঁশাঁশাঁ ধামধাম লেগেই থাকে কোথাও না কোথাও। আর গভীর রাতে দড়াম দাড়াম গরররগরররর চালু থাকে গড়তে থাকা প্লটগুলোতে। প্রতি বেলায় প্রায় আধঘন্টা ধরে শুনতে হয় সুরে বেসুরে তারস্বরে বিভিন্ন ডেসিমালের আযানও। মাঝে মাঝে একরোখা আজবমাথার রাজনৈতিক মিছিল দেখতে ছুটে যাই আর গলা মেলাতেও মজা পাই, ওরা বলে "এ্যাকশান! এ্যাকশান! ডাইরেক্ট এ্যাকশান!!!" কিসের এ্যাকশান, কোথায় এ্যাকশান, কেন এ্যাকশান, ভাবি, ছাই ওরাও কি জানে? তবুও এ্যাকশান হোক। ঠিকঠাক এ্যাকশান হলে মারতে না পারি ভিড় থেকে আমিও চ্যাঁচাবো "মার মার" বলে হয়তো। আশেপাশে, কিংবা দূরেও হতে পারে, যারা নাচ গানের আসর বসায় ছাদে কিংবা গলির মুখে ওরা এই পৃথিবীরই, আমিই একটা এলিয়েন নিশ্চিত, আমারই হয়তো একটা ফেক্টরি রিসেট করে ঠিকঠাক সফটঅয়্যার ইন্সটল করা জরুরী। কিন্তু যারা অন্তঃসারশূণ্য বক্তৃতা দিয়ে কিংবা ওয়াজ করে আকাশ বাতাস ফাটায় চরম নির্লজ্জের মতো ওদের শাস্তি অপরিহার্য, মানুষ হলে ওয়ান্ডার উমেন হব আগামী জন্মে সত্যি বলছি। পাখিরা আছে, থাকে, এখনো পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়নি তাই শুধু। ওদের ভাল থাকার কোন প্রশ্নই নেই, ওরা যখন কথা বলে, কাঁদে কিংবা আর্তনাদও করে গানের মতোই শোনায়। ওরা এই তল্লাটে কাউকেই বিশ্বাস করেনা আর ওদের বুকের ভেতরে আছে ধারালো হীরের টুকরো। আগের জন্মে ওরা কিছু না বুঝেই শিল্পী হতে চেয়েছিল আর উড়তেও চেয়েছিল।
এতো শব্দ... এতো শব্দ... একটু শান্তি মতো ঘুমোতে পারিনা যেন। মাথার ভেতরেও শব্দের তাড়া খেয়ে খেয়ে নাস্তানাবুদ হয়ে থাকি। বহু বছর আগে একটা দাদু ছিল, সান্তার মতো কিংবা একটু রবি ঠাকুরের মত সাদা চুলদাড়ি, ধুসর পাঞ্জাবি পরতো, তার পকেটে সবসময় থাকতো একমুঠো রঙিন লজেন্স। ভীড়ের ভেতর গলে গিয়ে একদিন দেখেছিলাম দাদুটা একটা খাটে নতুন সাদা কাপড় জড়িয়ে কি ঘুমটাই না ঘুমুচ্ছে। কবছর আগে বাবাও ঘুমিয়ে পড়লো প্রায় একই রকমই। ওরা আর কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছিল না। ওদের মুখের শান্তির হাসিটা বড় লোভ দেখায়।
হায় শব্দ !!! তোমাকেই ভালবাসি আর তোমার কাছ থেকেই মুক্তি চাই!
https://youtu.be/UIyRXvHmXxo
No comments:
Post a Comment